মাস তিনেক আগের কথা। টি ২০ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানের কাছে হেরে গেল ভারত। পরের ম্যাচ নিউজিল্যান্ড। সেই ম্যাচেও হারতে হল শোচনীয়ভাবে। বিশ্বকাপের দেওয়াল লিখন যেন পরিষ্কার। পরের তিন ম্যাচ জিতলেও অনেক ‘যদি–কিন্তু’র জটিল সমীকরণ। মোদ্দা কথা, বিরাট কোনও অঘটন না ঘটলে ভারতের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে।
মূলস্রোত মিডিয়া ও নেট দুনিয়ায় সবথেকে বেশি গালমন্দ বরাদ্দ হয়েছিল কার জন্য? যত দোষ নন্দ ঘোষের মতোই প্রায় সব দোষ এসে পড়েছিল হার্দিক পান্ডিয়ার ওপর। কেন তিনি বোলিং করছেন না? কেন তিনি চোট লুকিয়ে বিশ্বকাপের মতো মেগা আসরে নেমে পড়লেন? ব্যাট হাতেই বা কেন এমন জঘন্য পারফরমেন্স? আর কতদিন তাঁকে বয়ে বেড়ানো হবে? কার কোটায় তিনি খেলে চলেছেন? এমন নানা প্রশ্নের ঝড়। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা কুরুচিকর ইঙ্গিত তো আছেই।
যেন তিনি বল করলেই ভারত অনায়াসে জিতে যেত। যেখানে পাকিস্তানের একটি উইকেটও ফেলা গেল না, সেখানে হার্দিক বল করলেই বা কী এমন হেরফের ঘটত? তিনি না হয় মাত্র ১১ রান করেছেন, বাকিদের রান করতে কে বারণ করেছিল? আসলে, এটা অনেকদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ। যা বহিপ্রকাশের একটা উপলক্ষ্য খুঁজছিল। এই ক্ষোভ তৈরি হওয়ার পেছনে বরোদার এই অলরাউন্ডার নিজেও অনেকটা দায়ী।
তখন সবে কেরিয়ার শুরু। দু’বছর যেতে না যেতেই আওয়াজ তুলে দেওয়া হল, কপিলদেবের উত্তরসূরি এসে গেছেন। কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন, হার্দিকের যা প্রতিভা, তিনি কপিলকেও ছাপিয়ে যাবেন। ব্রেকিং নিউজ আর ফাস্টফুডের জমানায় মানুষের ধৈর্য বড়ই কম। দুমদাম একটা তুলনা টেনে দিলেই হল। একটা লেবেল সাঁটিয়ে দিলেই হল। একটা ম্যাচে কেউ ভাল খেললেই তাকে মাথায় তুলে দাও। আর ব্যর্থ হলেই আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলো।
কেউ যদি তাঁকে কপিলের সঙ্গে তুলনা করেই বসেন, এতে হার্দিকের দোষটা কোথায়? আসলে, হার্দিক নিজেও ভেবে বসেছিলেন, তিনি বোধ হয় কপিলের থেকেও বড় অলরাউন্ডার। তাই এই প্রশস্তি উপভোগ করছিলেন। মূলস্রোত মিডিয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনভাবে নিজেকে জাহির করতে শুরু করেছিলেন, যেন বিরাট এক ক্রিকেটার চলে এসেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের আঙিনায়। প্রাক্তনদের যেন ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাননি। আইপিএলে তিনিই আমেদাবাদের নতুন দলের অধিনায়ক। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হ্যাং ওভার কাটিয়ে নতুনভাবে নিজেকে মেলে ধরার একটা মঞ্চ। তার ওপর নেতৃত্ব। কিন্তু নেতৃত্ব কি তাঁকে দায়িত্বশীল করবে?
দিন কয়েক আগে সৌরভ গাঙ্গুলির কাছে প্রশ্ন ছিল, কীভাবে হার্দিকের কামব্যাক সম্ভব? তিনি বলেছিলেন, ‘ওকে আরও বেশি করে বোলিং করতে হবে। রনজি ট্রফিতে আরও বেশি করে বোলিং করে ছন্দে ফিরতে হবে।’ একইসঙ্গে বার্তা এবং পরামর্শ। অনুচ্চারিত বার্তাটা হল, ‘তোমাকে অলরাউন্ডার হিসেবেই ভাবা হচ্ছে। শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলবে, এমন জাতের ব্যাটসম্যান তুমি নও। ফিরতে হলে বোলিং করেই ফিরে আসতে হবে।’ আর পরামর্শটা হল, ‘রনজিতে মন দাও। তুমি এখনও খরচের খাতায় চলে যাওনি। তোমার দরজা এখনও খোলা।’
সৌরভ শুধু বোর্ড সভাপতি বা প্রাক্তন জাতীয় অধিনায়ক নন। ভারতীয় ক্রিকেটে কামব্যাকের সবচেয়ে উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত। ৪৯ টেস্টে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া সৌরভকে যখন বাদ দেওয়া হয়, চরম প্রতিকূলতার মাঝেও ফিরে আসার লড়াই চালিয়ে গেছেন। এমন এমন মাঠে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে হয়েছে, যা ঘেরা মাঠও নয়। তবু হাল ছাড়েননি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছেন। দলের বাইরে থাকা একজন ক্রিকেটারের মনের ভেতর কী ঝড় বয়ে যায়, তাঁর থেকে ভাল কজন বোঝেন? সেখানে হার্দিক তাঁর পরামর্শকে কিনা ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। তিনদিন যেতে না যেতেই জানিয়ে দিলেন, তিনি বরোদার হয়ে রনজি খেলবেন না। চোটের কারণে নয়। আসলে, তিনি নাকি লাল বলের ক্রিকেটে তেমন আগ্রহী নন। সাদা বলের ক্রিকেটে ফোকাস করতে চান। শুধু তাই নয়, দিন সাতেক আগে এক সাক্ষাৎকারে বলে বসলেন, ‘টি২০ বিশ্বকাপে আমাকে অলরাউন্ডার হিসেবে নেওয়া হয়নি। একজন স্পেশ্যালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে নেওয়া হয়েছিল।’ নিজের সাফাই গাইতে গিয়ে যা খুশি তাই বলে যাচ্ছেন। তাঁকে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে নেওয়া হয়েছিল, এমন কথা কে জানিয়েছিলেন? নিজেকে এত বড় মাপের ব্যাটসম্যান ভেবে বসলেন কোন আক্কেলে?
আসলে, আইপিএলের কাঁচা টাকা আর সোশ্যাল মিডিয়ার আবহে এমন একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’ সংস্কৃতির আমদানি হয়েছে, যা ক্রিকেটারদের দ্রুত বিপথগামী করে তুলছে। বিরাট কোহলির মতো তিনিও অহরহ ছবি সাঁটিয়ে যান। একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরকে টেনে আনেন জনতার দরবারে। যেমন বিকট পোশাক, তেমন বিকট অঙ্গভঙ্গি। রুচির ছাপ নেই, বরং ছত্রে ছত্রে অশিক্ষা আর হ্যাংলামি। সবকিছুই যেন পোজ দেওয়া। জিম করছেন, চোখ সেই ক্যামেরার দিকে। ক্যাচ নিচ্ছেন, তাও যেন ছবি তোলার ইভেন্ট। প্রস্তুতি সারতে হয় নীরবে, লোকদেখিয়ে নয়। সৌরভ যখন কামব্যাকের লড়াই লড়ছেন, বাড়ির সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত মিডিয়া। কিন্তু সৌরভ বেরিয়ে যেতেন কাকভোরে, মিডিয়ার নাগাল এড়িয়ে চলত ফিরে আসার লড়াই। সেখানে হার্দিকদের সবকিছুই যেন ছবির ইভেন্ট। মোদ্দা কথা, ফোকাসটাই যেন ছবির দিকে চলে গেছে। সৌরভকে দেখে এঁরা কিছুও যদি শিখতেন!