তাঁর ক্রিকেট-রীতির রূপ ছিল অনন্য। বোলারকে দমন করাই ছিল তাঁর ব্যাটিং উপাসনার আদি ও অকৃত্রিম মন্ত্র – “আমি যখন ক্রিজে ব্যাট হাতে থাকবো, তখন আক্রমণেই থাকবো আমি।” দৃষ্টিশক্তি, ফুটওয়ার্ক আর মধুর সময়জ্ঞান ছিল তাঁর ব্যাটিং রূপকথার প্রাণ, ঐশ্বর্য্য ও স্বাধীনতা। আর সেই অবাধ, অভিজাত ও বশ্যতাবিমুখ শিল্পকর্ম দেখাও ছিল এক অফুরন্ত আনন্দময় অভিজ্ঞতা। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই লাবণ্যময়, বাঁ-হাতি অলরাউন্ডারের নাম ফ্র্যাঙ্ক এডওয়ার্ড উলি। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির মতোই দীর্ঘকায় যাঁর ক্রিকেটীয় উচ্চতা। গুণকীর্তনে বসলে শব্দভান্ডারের সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়ে পড়তে বাধ্য।
৬৪ টেস্টে ৫ টি সেঞ্চুরিসহ ৩,২৮৩ রান, ৮৩ উইকেট, কিংবা ৬৪ টি ক্যাচ ধরার নজিরে তেমন কিছু চোখ টানার আকর্ষণ নেই। কিন্তু প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সার্বিক দক্ষতায় উলির নাগাল পাওয়া সত্যিই কঠিন। কেরিয়ারে ৯৭৮ টি ম্যাচ খেলেছেন, সংখ্যার দিক দিয়ে যেটা একমাত্র উইলফ্রেড রোডসের (১,১১০) পরেই। রান করেছেন ৫৮,৯৫৯ যার থেকে এগিয়ে একমাত্র জ্যাক হবস (৬১,৭৬০)। সর্বোচ্চ ইনিংস অপরাজিত ৩০৫। ২০৫ মিনিটে ট্রিপল সেঞ্চুরির কীর্তিটি সময়ের দিক দিয়ে এখনও দ্বিতীয়। তাঁর ১৪৫ টি শতরানের নজিরটি আজও ইতিহাসে সপ্তম স্থানে দাঁড়িয়ে। শুধু ব্যাটিং নয়, এর সঙ্গে বাঁ-হাতি স্পিনে উইকেট তুলেছেন ২,০৬৬ টি এবং শুধু বোলিংও নয়, ক্যাচও ধরেছেন ১,০১৮ টি (যার অধিকাংশই প্রথম স্লিপে দাঁড়িয়ে), যে সর্বকালীন রেকর্ড আজও কোনও ফিল্ডারের ঝুলিতে নেই। হ্যাঁ, এই গোটা অল-রাউন্ড প্যাকেজটার নামই ফ্র্যাঙ্ক উলি ।
তাঁর কোচ কলিন ব্লাইথের চোটের কারণে মাত্র ১৯ বছর বয়সে, ১৯০৬ সালে, কেন্ট কাউন্টির হয়ে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে আবির্ভাব উলির। ওল্ড ট্রাফোর্ডে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিরুদ্ধে মাত্র তিন বলে “শূন্য’ রানে আউট।উইকেট নেন মাত্র একটি। এবং জনি টিল্ডসলের ক্যাচ ফস্কান, যার ফলে টিল্ডসলে করে ফেলেন অপরাজিত ২৯৫। বাদ পড়ারই কথা, কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৪ নট আউট থাকায় পরের ম্যাচে সমারসেটের বিপক্ষে আবার সুযোগ আসে। ম্যাচে ৬ উইকেট নেওয়ায় তৃতীয় ম্যাচে সারের বিরুদ্ধেও আরেকটি একটা সুযোগ পান উলি। এবার আরও একটু উন্নতির চিহ্ন স্পষ্ট হয়। দ্বিতীয় ইনিংসে (৮০ রানে) ৫ উইকেটসহ ম্যাচে মোট ৮ উইকেট, সেইসঙ্গে প্রথম ইনিংসে ৭২ আর দ্বিতীয় দফায় ২৩ নট আউট থেকে ম্যাচ জেতানো। পরের ম্যাচে হ্যাম্পশায়ারের বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাসের চূড়োয়-থাকা উলির ব্যাট থেকে আসে ‘প্রথম’ সেঞ্চুরি (১১৬) এবং একইসঙ্গে ৮ উইকেট! আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সেবারই ‘প্রথম’ কাউন্টি চ্যাম্পিয়ন হয় কেন্ট। আর প্রথম ‘ক্যাপ’ পাওয়া উলি করেন মোট ৭৭৯ রান আর তোলেন ৪২ উইকেট। বলা যেতে পারে, একজন নবাগতের পক্ষে অবিশ্বাস্য সূচনা।ভাবা যায়, এই মানুষটির ব্যাটেই অর্জিত হয়েছে মরশুমে ২৮ বার ১,০০০ রান, যে রেকর্ড আছে একমাত্র ডব্লিউজি গ্রেসের। সিজনে ২,০০০ রান করার কৃতি্ত্ব দেখিয়েছেন অন্তত ১২ বার, যার মধ্যে ১৯২৮ সালে হাঁকান ৩,৩৫২ রান। মরশুমে ১,০০০ রান এবং ১০০ উইকেট তোলেন নয়-নয় করেও ৮ বার!
মনে হতেই পারে, বাড়তি কি ছিল তাঁর ব্যাটিংয়ে, যা বিভিন্ন সমালোচক বিমুগ্ধ-বন্দনায় ভরিয়ে দিয়েছেন।সাধে কি আর নেভিল কার্ডাসের মতো মানুষ লিখেছিলেন: “আর কোনও ক্রিকেটার বোধহয় এই মেঠো খেলাটিকে এমন বিশ্বস্ততা ও আকর্ষণীয় ছোঁয়া দিতে পারেননি।” বার্কলের ‘World of Cricket’ বইতে হ্যারি আলথাম লেখেন “তাঁর আশ্চর্য ব্যাটিং রোমান্সের মধ্যে স্কোরবোর্ডের কোনও ভূমিকা নেই।” আসলে, তাঁর স্ট্রোকের লাবণ্যময় সৌন্দর্য ও তীব্রতা দেখে মনে হতো, বোলারটিকে তাঁর সামনে আনাটাই যেন মস্ত ভুল। সীমানায় আছড়ে-পড়া বাউন্ডারি দেখার পর মনে হতো ফিল্ডাররা যেন ভুল জায়গায় পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে। বিশেষত, লম্বা রিচে সামনের পায়ে স্বতঃস্ফূর্ত ড্রাইভ, প্লেসমেন্ট এবং কল্পনাতীত ধারাবাহিকতা তাঁকে এক শৃঙ্গ থেকে পৌঁছে দিয়েছিল উচ্চতার উন্নততর শৃঙ্গে। এবং এরপরেও জানানো যাক, কেরিয়ারে ৯০ থেকে ৯৯ রানের কোঠায় তিনি আউট হয়েছিলেন ৩৫ বার, এই তথ্য পরিসংখ্যানবিদদের কাছে শুনে উলি বলেছিলেন: “বিশ্বাস করতে পারেন, কোনও ক্ষেত্রেই আমি ‘নার্ভাস নাইনটি’-র শিকার হইনি। মারার বল পেলেই আমি আক্রমণ করেছি ।নিজের সেঞ্চুরির কথা না ভেবে চেষ্টা চালিয়েছি দলের স্বার্থ রক্ষার।” এমন লোক অন্য, অনন্য উচ্চতায় থাকবেন এতে আর আশ্চর্য কি? বলে রাখি, ১৮৮৭ সালের আজকের তারিখে (২৭ মে) জন্মেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক এডওয়ার্ড উলি।