অমল দত্তর একটি চিরস্মরণীয় উক্তি মনে পড়ে গেল— ‘জীবিতকালে যাকে তুমি এক কাপ চা খাওয়াওনি, তার মৃতদেহের সামনে একশো টাকার মালা কিনে হাজির হয় অনেকে।’ শেন ওয়ার্নের মৃত্যুর পর সর্বত্র যে শোকের আবহ দেখা যাচ্ছে, তাতে কোনও ভেজাল নেই। কিন্তু তার মানে এই নয়, তাঁকে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা লেগ-স্পিনারের স্বীকৃতি দিতে হবে। ক্রিকেটপ্রেমী, তাঁর ইচ্ছেমতো রায় দিতেই পারেন। কিন্তু যে মানুষটা ১০,১২২ রান করেছেন টেস্টে, যাঁকে তেমনভাবে কোনও স্পিনার অস্বস্তিতে ফেলতে পারেননি, তিনি তো তাঁর পছন্দের কথাই বলবেন। ভারতের বিরুদ্ধে খেলা ১৪ টেস্টে ৪৩ উইকেট পাওয়া শেন ওয়ার্নের বোলিং গড় ৪৭.১৮। ভারতের কোনও ব্যাটারের তাঁকে খেলতে তেমন বেগ পেতে হয়নি, তবু তাঁকে দুনিয়ার সেরা স্পিনারের স্বীকৃতি দিতে হবে? এই প্রশ্নটাই তো তুলেছিলেন গাভাসকার। পরোক্ষে। অথচ সাধারণ জনতা হাতে মোবাইল অথবা ল্যাপটপ থাকায় যা খুশি বলে যাচ্ছেন নিয়ম করেই। তর সওয়ার প্রশ্ন নেই। শুধু মন্তব্য করতে হবে। প্রায় ক্ষেত্রেই অযাচিত কথাবার্তা বলছেন তাঁরা। তা না হলে সুনীল গাভাসকার তাঁর পছন্দের কথা বলা সত্ত্বেও তাঁর দিকে সমালোচনার তীর ছোঁড়া হবে কেন? কোন যুক্তিতে? এঁদের অধিকাংশই নিজের বাড়ির বারান্দায়, নিজের ছেলে বা ভাইপোর বোলিংয়ের সামনেও জীবনে ১০,১২২ রান করতে পারবেন না। তবু, ড্রয়িং-রুমে বসে ক্রিকেট দেখার সঙ্গে সঙ্গে স্বঘোষিত সমালোচক হয়ে উঠেছেন। শুধুমাত্র সুনীল গাভাসকার নয়, এঁরা কিন্তু যাঁকে পাচ্ছেন, তাঁর বিরুদ্ধে টাইপ করতে শুরু করছেন। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এর ফলে নেটিজেনদের সম্পর্কে আগ্রহ হারাচ্ছেন প্রচুর মানুষ। এঁদের মাঝে অনেকেই আছেন, যাঁরা সত্যিই পণ্ডিত। ভাল ভাল মন্তব্য করছেন। তাঁদের বদনাম হয়ে যাচ্ছে ওই সব-জান্তা বাবাজিদের জন্য।
শেন ওয়ার্নের মৃত্যুর পর অদ্ভুত একটা আবেগের ঢেউ গোটা দুনিয়া জুড়ে। মাত্র ৫২ বছর বয়সে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন এক মহান শিল্পী। চোখের জল রোখা মুশকিল। কাঁদছি তো আমরাও। কিন্তু তিনিই দুনিয়ার সর্বকালের সেরা স্পিনার, এমন হাওয়ায় গা ভাসাতেই হবে! ভিন্নমত থাকতে পারে না? গাভাসকার শুধু একা নন, গারফিল্ড সোবার্স পর্যন্ত বলেছেন বারবার, ‘সুভাষ গুপ্তের চেয়ে বড় লেগ-স্পিনার দুনিয়ায় আসেনি।’ হ্যাঁ, ওয়ার্নের বোলিং দেখেই এমন মন্তব্য তিনি করেছিলেন। এমনকি, মাইক গ্যাটিংকে করা ‘শতাব্দীর সেরা বল’ দেখেও তাঁর সুভাষ গুপ্তে সম্পর্কে করা মূল্যায়ন থেকে নড়ে যাননি। অথচ, নেটিজেনরা ব্যাপারটা না বুঝে ঢিল ছুঁড়ে দিলেন গাভাসকারের উদ্দেশে। গাভাসকার তো তুলনা করতে চাননি। জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এটা তুলনা করার সময় নয়।’
তবু বলব, এ ধরনের বিতর্কিত প্রশ্নগুলোকে সামাল দেওয়ার জন্য নিজের ব্যাটিং ঘরানার সাহায্য নিতে পারতেন। বিতর্কিত বলটা ছেড়ে দিলে হয়তো এভাবে অপমানিত হতে হত না। গাভাসকারের সমর্থনে ভারতের কোনও প্রাক্তন ক্রিকেটার এগিয়ে না আসায় অবাক হইনি। কারণ, বরাবরই তো তিনি একা লড়াই করে এসেছেন। মন খারাপ হয়েছে তাঁরও। বিতর্ক থামানোর জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন এই বলে যে, এই সময়ে ওই কথাটা না বললেও পারতেন। আমরাও শেন ওয়ার্নের জাদু দেখেছি। আপ্লুত হয়েছি আনন্দে। কিন্তু তাঁকেই সেরা স্পিনারের মসনদে বসাতে নারাজ। বরং আবেগের থেকে যুক্তির দিকেই ঝুঁকতে ইচ্ছে করে।
গাভাসকারকে দেখুন। যে–ই বুঝেছেন, একটা বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন এ কথা বলে যে, আবেগের সময় এমন মন্তব্য না করলেই পারতেন। কোনও দরকার ছিল না। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এটাও কিন্তু বলেননি যে, নেটিজেনদের চাপে তিনি তাঁর মন্তব্য ফিরিয়ে নিয়েছেন। এবং মনে করছেন, শেন ওয়ার্নই দুনিয়ার সর্বকালের সেরা লেগ-স্পিনার। একেবারেই নয়। যতটুকু দরকার, সেটুকুই বলেছেন। ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের যেভাবে নাকানিচোবানি খাইয়েছেন, তা দেখে আমাদের চেয়েও বেশি আপ্লুত ওদেশের সমর্থকরা। তাই, ওঁরা মেনে নিতে পারছেন না যে, কেন ওয়ার্ন সেরা নন। আমরা শুধু ওয়ার্নের পরিসংখ্যানে চোখ বোলানোর অনুরোধ করতে পারি। মন দিয়ে আগাপাশতলা এই রেকর্ডের মালায় চোখ বোলালেই বোঝা যাবে, এশিয়ার ব্যাটসম্যানরা ওয়ার্ন সম্পর্কে কোনও আতঙ্কে ভোগেননি। সেখানে গাভাসকার কেনই বা তাঁকে সেরা আসনে বসাবেন? ওয়ার্নের হাত থেকে বেরিয়েছে বেশ কয়েকটি অবিস্মরণীয় ডেলিভারি। মানতে আপত্তি নেই। এটাও মানতে আপত্তি নেই যে, তিনি দুর্দান্ত স্লিপ ফিল্ডার ছিলেন। ব্যাটের হাতও ছিল ভাল। অত্যন্ত উর্বর ক্রিকেট মস্তিষ্কের মালিক। এবং অবশ্যই এক রঙিন চরিত্র। ৫২ বছর বয়সে চলে যাওয়াটা দুঃখের তো বটেই, তাই বলে, তাঁকে সেরা লেগ স্পিনারের স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরাই হোঁচট খাচ্ছি, তো সেখানে গাভাসকার কী করে তাঁকে এই সার্টিফিকেট দেবেন?