১০ই জুলাই তারিখটা উল্লেখ করলে বেশ কিছুসংখ্যক ক্রিকেটপ্রেমীই হয়ত লাফিয়ে উঠবেন, বিশেষত তাঁরা যদি ভারতীয় হন। আর এই লাফিয়ে-ওঠা ভারতীয়দের মধ্যে অনেকে লাফাবেন আনন্দে; আবার কেউ কেউ [ক্রিকেটীয় সৌভাগ্যবশত এঁরা এখনও সংখ্যালঘু, যদিও সামাজিক-মাধ্যমে বেশ উচ্চকিত!] লাফাবেন বিতৃষ্ণায়-বিরক্তিতে – আবার সেই ‘জোকার’-টাকে নিয়ে কথা – উনি তো একবছর আগেই ৬ই মার্চ টেস্ট-ক্রিকেটে অভিষেকের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করে কেক-টেক কেটে ‘superannuated’ ও ‘senile’ হয়ে গেছেন – তাঁকে নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে আবার কি হবে! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন – জটায়ুর ভাষায় “কোনও প্রশ্ন নয়।“
নাহ্, আমি ১৯৪৯ সালের ১০ই জুলাইয়ের বম্বের কোনও হাসপাতালের এক নবজাতকের কথা বলতে যাচ্ছিনা – আমার এই রচনা ১৯৭৬ সালের ১০ই জুলাইয়ের ম্যাঞ্চেস্টারের এক ঘটনার কথা নিয়ে, তবে এতেও আছে ওপেনিং ব্যাটিংয়ের শিহরণ আর বিলক্ষণ লুকিয়ে রয়েছে হাসপাতালে যাওয়ার সম্ভাবনা।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ‘গ্রোভেল’ টেস্ট-সিরিজের তৃতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনে (শনিবারের বিকেল) ইংল্যান্ড চতুর্থ ইনিংসে খেলতে নামছে – কাঁধে ৫৫১ রানের বোঝা, রয়েছে ঠিক আগের ইনিংসে ৭১ রানে ধ্বসে পড়ার লাঞ্ছনা, তৃতীয় ইনিংসে মাঠে ওভার-প্রতি সাড়ে-তিনেরও বেশি হারে চারশোরও বেশি রানের খাটান দেওয়া, সামনে রবার্টস-হোল্ডিং-ড্যানিয়েল পেসার-ত্রয়ী। ট্রেন্টব্রিজ ও লর্ডসের প্রথম দুটো টেস্টে মোটামুটি সমান-সমান খেলা হয়ে দুটোই অমীমাংসিত। তবে এ ম্যাচে ব্রিটিশ সিংহের দশা রীতিমত কাহিল।
কারা নামছেন ওপেন করতে? দুজন বাঁ-হাতি, যাঁদের মিলিত বয়স প্রায় ৮৫ – আজ্ঞে হ্যাঁ, বয়োজ্যেষ্ঠ জনের বয়স প্রায় সাড়ে-পঁয়তাল্লিশ, (না, ভুল পড়ছেন না!) ১৯৪৯ সালে তঁর টেস্ট-অভিষেকের সময় বিপক্ষের অধিনায়ক লয়েড-এর বয়স পাঁচবছরও পূর্ণ হয়নি, এবং কনিষ্ঠজন, সদ্য ঊনচল্লিশ-ছোঁয়া, ১৯৭১ সালের সর্বপ্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় – ডেনিস ব্রায়ান ক্লোজ এবং জন হিউ এডরিচ।
সেদিন সওয়া-এক ঘন্টা ধরে মাঠে যেন বয়ে গেছিল আতঙ্কের ঝড়, দর্শকরা ভীত স্তব্ধ হয়ে দেখেছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ‘মারাত্মক’ পেস-বোলিংয়ের বিরুদ্ধে দুই (বর্তমানের পাড়ার শব্দভান্ডার অনুযায়ী) ‘জ্যেঠু-কাকু’ ওপেনারের আক্ষরিক অর্থেই ‘সর্বাঙ্গ দিয়ে’ উইকেট বাঁচানোর লড়াই। মনে করিয়ে দিই যে তখন ক্রিকেট-মাঠে হেলমেট চালু হয়নি, ছিলনা এতরকমের শরীর-বাঁচানোর সরঞ্জামও; ওভারে বাউন্সারের সংখ্যা নিয়ে আম্পায়ারদের এত কড়াকড়িও ছিলনা আর ঐ ৭৫ মিনিটে করা হয়েছিল ১৪ ওভার যার মধ্যে বেশ কয়েকটা নো-বলও ছিল! প্রসঙ্গত বলি এই সময়টার রেডিও-কমেন্টারিটা আমি শুনেছিলাম, যদিও কারা কারা ভাষ্যকার ছিলেন সেটা আজ আর মনে নেই – বিবিসির রেকর্ড খুঁজলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
নির্মম সেই বোলিং – মাঝে মাঝেই মাথা-তাক-করা বাউন্সার (ইন্টারনেটে খুঁজলে ভিডিও পাবেন) – ড্যানিয়েল ওভার-প্রতি অন্তত দুটো করে শর্ট-বল দিচ্ছিলেন, হোল্ডিং আরো বেশি – তবুও ‘বুড়ো’ ওপেনাররা উইকেট ছুঁড়ে দেননি। লয়েড পরে বলেন যে তাঁর বোলাররা, “… went flat out, sacrificing accuracy for speed.” ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেসাররা অত জোরে বল করায় পিচের ওপরের ভাগটা (surface) ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং ব্যাটিং করা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল আরো কঠিন।
আম্পায়ার বিল অ্যালে – অস্ট্রেলিয়া-জাত সুদক্ষ অল-রাউন্ডার যিনি নিউ সাউথ ওয়েলস ও সমারসেট-এর হয়ে ২৩ বছরে শ’চারেক প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছিলেন – প্রথমে খুব একটা গা করেননি, কিন্তু পরে শেষ পর্যন্ত হোল্ডিং-কে সতর্ক করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে অ্যালে ও ক্লোজ-এর মধ্যে এরপরের সংলাপটি নাকি এরকম ছিল:
- “What the hell did you have to do that for?” asked an agitated Close.
- “He’s bowling too many bouncers.” Came Alley’s confused response.
- “Don’t you realise the bloody bouncers aren’t hitting us? It’s the ones halfway down that are the problem.”
কতটা সাহস, আত্মবিশ্বাস ও ক্রিকেটীয় বুদ্ধি থাকলে এমন বলা যায় – ভেবে দেখুন!
দুটো আঘাত এহেন ক্লোজ-কেও ‘হিলা দিয়া’ – একটা তাঁর পাঁজরে (ইন্টারনেটে ছবি দেখে নিতে পারেন) আর একটা তাঁর তলপেটে। আর একবার একচুলের জন্য তাঁর টাক-মাথাটি বেঁচে যায়। অন্যদিকে এডরিচের ভাগেও তাঁর বরাদ্দ আঘাত পড়েছিল। হোল্ডিং সম্ভবত সাত ওভার বল করেছিলেন, রান প্রায় দেনই নি কারণ খুব কম ডেলিভারিই pitched up ছিল আর ব্যাটারদ্বয় ব্যস্ত ছিলেন শরীর বাঁচাতে ও আঘাত পেতে।
তবে সবথেকে বিস্ময়কর ব্যাপারটা ছিল যে ব্যাটাররা কাউন্টার-অ্যাটাক করতে গিয়ে উইকেট খোয়াননি; হুক-পুল-কাট করা থেকে বিরত হয়ে টিঁকে থেকে ছিলেন, কারণ তাঁরা ঐদিন কোনই উইকেট খোয়াতে চাননি – তাঁরা জানতেন যে শরীরে আঘাত পেতেই হবে, “… but we had a job to do.”, ক্লোজ নাকি পরে বলেন।
দিনের শেষে ইংল্যান্ড ২১-০, এডরিচ ১০ ও ক্লোজ ১, বাকি ১০ রান অতিরিক্ত খাতে। ইংরেজ অধিনায়ক গ্রেগ বলেন: “I thought Close and Edrich were magnificent. I don’t know of many opening partnerships in the world who would have done what they did. There might be one or two players who would have hooked a couple and got out, but they were asked to stay there and they did a great job.”
‘উইজডেন’ বাড়তি কথা খরচ না করে লিখেছিল: “The period before the close of the third day brought disquieting cricket as Edrich and Close grimly defended their wickets and themselves against fast bowling, which was frequently too wild and too hostile to be acceptable.”
শেষ করি এই ঘটনাটা দিয়ে; শোনা / পড়া কথা, তাই সত্যি-মিথ্যে জানিনা, তবে এঁদের চরিত্রটা বুঝতে পারা যায়:
“Close and Edrich walked off with their heads held high. On their way back Edrich suddenly broke into laughter. A livid Close asked the reason.
‘I’ve just looked at the scorecard. You’ve been out there for 70 [sic] minutes and had been clobbered everywhere. Do you know how many runs you’ve scored in that time?’ Close confessed he did not.
‘One. I hope it was worth the pain.’ Responded a laughing Edrich.”
এমন ‘নির্বিকার’ ক্রিকেটীয় চরিত্র আজকাল বোধহয় আর বিশেষ দেখা যায়না। ভারি ব্যাট, হেলমেট ও আত্মরক্ষার সরঞ্জামের সমারোহ, ছোট মাঠ আর (পেস) বোলারদের ওপর বিধি-নিষেধের ঝাঁক, এইসব ‘যোদ্ধা’-দের ‘বিরল প্রজাতি’ করে দিয়েছে।