দৃশ্য#১ – স্থান: মেলবোর্ন, কাল: ১৯৬১ সালে ফেব্রুয়ারির মাঝমাঝি কোনও একটা দিন
“শেষ ছবিটি বোধহয় এই – দু’টি হাসিমুখের ছবি। ওরেল বেনোডের হাতে তুলে দিচ্ছেন ওরেল-কাপ। স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান ওরেল-কাপ প্রবর্তনের ব্যবস্থা করেছেন। … কাপের উপর ব্রিসবেন (‘টাই’) টেস্টের শেষ বলটি বাঁধানো। ওরেলের নামে কাপটির নামকরণ ক’রে জীবিত খেলোয়াড়কে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কাপটিকে শেষ বারের মত কোটের হাতা দিয়ে ঘষে উজ্জ্বল ক’রে ওরেল বেনোডের হাতে তুলে দিলেন – বিজয়ীর পুরস্কার; বেনোড সিরিজ জিতেছেন। ওরেল হাসছেন – সমস্ত সত্তা বিকীর্ণ হয়েছে সেই মুক্ত হাসিতে। বেনোডও হাসছেন – সাফল্যের স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে তাঁর মুখ ভ’রে আছে। আর কাপটি হাতে তুলে দেবার সময় স্বয়ং ওরেল ভাবছেন, বলছেনও বটে, ‘যখন আমার দেশবাসী আমাকে জিজ্ঞাসা করবে ঐ কাপটি কি রকম দেখতে – আমি উত্তরে কি বলব?’ পরাজয়কে এর থেকে নাটকীয় বিষাদের মধুরতা আর কে দিতে পেরেছে?” – শঙ্করীপ্রসাদ বসু, “রমণীয় ক্রিকেট”, ২য় মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ২২১-২২২।
১৯৬০-৬১ মরশুমে অস্ট্রেলিয়াতে অসাধারণ এক পাঁচ-টেস্টের সিরিজে ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল রিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়া দলের কাছে ১-২ ম্যাচে হেরে যায়। ব্রিসবেনের প্রথম ম্যাচটি ‘টাই’ হয়েছিল – টেস্ট-ক্রিকেটের (সে যাবৎ) ৮৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার – আর অ্যাডিলেডের চতুর্থ ম্যাচটি শেষ দিনে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাময় দেড়-ঘন্টারও বেশি সময়ব্যাপী অস্ট্রেলিয়ান শেষ উইকেট জুটির পাথর-গাঁথা আত্মরক্ষায় ‘ড্র’ হয়। বিখ্যাত অস্ট্রেলীয় ধারাভাষ্যকার অ্যালান ম্যাকগিলভ্রে বলেছিলেন সেই সিরিজের বিশাল সাফল্য ও প্রবল জনপ্রিয়তার সিংহভাগের অংশীদার ছিল ওরেলের অধিনায়কত্ব। তিনি ছিলেন তাঁর দলের খেলোয়াড়দের কাছে পিতৃপ্রতিম। দুই দেশের মধ্যে ক্রিকেট খেলায় দলীয় স্মারকের নাম তখনও-খেলেন এমন কোনও ক্রিকেটারের নামে সম্ভবত সেই প্রথম চালু হয়, তাঁর নামেই ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ট্রফি, যা অস্ট্রেলিয়া বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট-সিরিজের বিজয়ী দলকে দেওয়া হয় আজও।
পিছিয়ে যাই প্রায় আড়াই দশক, অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারের বাসনায় গাবি অ্যালেনের ইংল্যান্ড দল এসেছে অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৩৬-৩৭ মরশুমে, বিপক্ষ নতুন অধিনায়ক ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া দল যাদের প্রথম টেস্টের একাদশে চারজন টেস্ট-অভিষেককারী।
দৃশ্য#২ – স্থান: ব্রিসবেন, কাল: ১৯৩৬ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর প্রথম টেস্টের প্রথম দিনের সকাল।
সিরিজের প্রথম বলেই চমক – টসে জিতে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ডের ওপেনার স্ট্যান ওয়ার্দিংটন (০) প্রথম বলেই উইকেট-রক্ষক বার্ট ওল্ডফিল্ডের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন। কিছু পরে, দলীয় ২০ রানের মাথায় তিন-নম্বর ব্যাটার আর্থার ফ্যাগ (৪) একইভাবে ফিরলেন। নামলেন তৎকালীন ক্রিকেট-দুনিয়ায় ব্র্যাডম্যানের সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাটার, ওয়ালি হ্যামন্ড। আবার চমক – প্রথম বলেই তাঁকেও ফিরতে হ’ল শূন্য হাতে, টেস্ট-অভিষেককারী রে রবিনসনের হাতে ক্যাচ তুলে – হ্যামন্ডের জীবনের প্রথম ‘অ্যাশেজ ডাক’! তিনটে উইকেটই নিলেন একজন বোলার – তিনি কে? অ্যাশেজে প্রথমবার খেলতে-নামা, একবছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট-অভিষেক সিরিজে পাঁচ ম্যাচে ১৫টা উইকেট নেওয়া, বছর ত্রিশের পেসার, আর্নেস্ট লেসলি (‘আর্নি’) ম্যাককর্মিক। দুর্ভাগ্যবশত পিঠের ব্যথার জন্য তিনি ঐ ম্যাচে প্রথম ইনিংসে মাত্র আট ওভার বল করতে পেরেছিলেন – ৮-১-২৬-৩ – দ্বিতীয় ইনিংসে মোটেই বল করতে পারেননি। তবে বলটা বেশ জোরেই করতেন, যখন ফিট থাকতেন।
এগিয়ে যাই বছর-দেড়েক, অ্যাশেজ দখলে রাখবার বাসনায় ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া দল এসেছে ইংল্যান্ডে ১৯৩৮ সালের গ্রীষ্মকালে। দলের একমাত্র প্রকৃত পেসার ‘আর্নি’। কিন্তু সফরের শুরুতেই তাঁর সে যে কি হেনস্থা! শোনা যাক সেই কাহিনী, উরস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে সফরকারী দলের প্রথম প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে।
দৃশ্য#৩ – স্থান: উরস্টারশায়ার, কাল: ১৯৩৮ সালের ২রা মে, ম্যাচের দ্বিতীয় দিন।
অস্ট্রেলিয়া (ব্র্যাডম্যানের ‘মাত্র’ ২৫৮ সমেত) ‘যৎসামান্য’ ৫৪১ রানে ইনিংস শেষ করবার পর বোলিং শুরু ক’রে ‘আর্নি’-র প্রথম তিন ওভারে ১৯টা নো-বল হ’ল, গোটা ম্যাচে তাঁর নো-বল ছিল ৩৫টা – মূলত ‘over-stepping’-এর জন্য – দুই আম্পায়ার ছিলেন হার্বার্ট বল্ডউইন ও জ্যাক স্মার্ট। ম্যাচে ‘আর্নি’ পেলেন ২০-২-৯৫-১ – সবেধন নীলমণি ঐ একটা উইকেট পান দ্বিতীয় ইনিংসে, শিকারটি ছিলেন (বিপক্ষের উইকেট-রক্ষক ও) পরবর্তীকালের বিখ্যাত আম্পায়ার সিড বুলার – এও কি অদৃষ্টের কোনও পরিহাস! তবে সফরকারী দল ম্যাচটা ইনিংস ও ৭৭ রানে জেতে – ফ্লিটউড-স্মিথ ১১টা ও ও’রিলি চারটে উইকেট নেন।
এগিয়ে যাই মাস-দেড়েক। ইতিমধ্যে, প্রথম টেস্ট ট্রেন্টব্রিজে বড়-রানের ম্যাচে – দু’দলের তিন ইনিংস মিলিয়ে উইকেট পড়েছিল ২৪টা, রান হয়েছিল প্রায় দেড়-হাজার, আর সেঞ্চুরি হয়েছিল সাতটা, দু’টো ডবল-সেঞ্চুরি সমেত, যার মধ্যে একটা স্ট্যান ম্যাককেব-এর অবিস্মরণীয় সেই ২৩২, উইকেটে থাকাকালীন ৩০০ রানের মধ্যে – ‘ফলো-অন’ করেও অস্ট্রেলিয়া ‘ড্র’ করেছে, ‘আর্নি’-র সংগ্রহ হয়েছে ৩২-৪-১০৮-১, একটিই ইনিংসে বল ক’রে। দ্বিতীয় টেস্ট লর্ডস মাঠে, ইংল্যান্ড টসে জিতে ব্যাট করছে।
দৃশ্য#৪ – স্থান: লর্ডস, কাল: ১৯৩৮ সালের ২৪শে জুন, দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিন।
“একটু আগে দুরন্ত ফাস্ট-বোলার ম্যাককর্মিক ঝোড়ো হাওয়ায় ইংল্যান্ডকে তচনচ করে দিয়েছেন। হাত ঘুরিয়েছেন বার পঁচিশেক, তাতেই কুপোকাৎ। লেন হাটন (৪), চার্লি বার্নেট (১৮), বিল এডরিচ (০), তিন তিনজন নামী ব্যাটসম্যান ফিরে গিয়েছেন। খেলা শুরু হতে না হতেই যেন ইংল্যান্ডের সারা! দিনের আলো সারা মাঠে চকচক করছে বটে, কিন্তু ইংরেজ-সমর্থকদের মনের অন্ধকার যাবার নয়। গেলো-গেলো হাঁক তুলে ১৯৩৮ সালের এক সকালে লর্ডস মাঠ যেন আঁতকে উঠেছে। এমন সময় মাঠে নামছেন ওয়ালি হ্যামন্ড।“ – অজয় বসু, “ব্যাটে বলে ক্রিকেট”, ১ম মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ৬৮।
এবারও হ্যামন্ডকে ‘আার্নি’-ই ফেরালেন ঠিকই (বোল্ড ক’রে), কিন্তু ততক্ষণে ইংল্যান্ড ৩১-৩ থেকে পৌঁছে গেছে ৪৫৭-৬ – হ্যামন্ড (২৪০) উল্টে দাবড়ে দিয়েছেন বিপক্ষকে, এডি পেন্টার (৯৯) ও লেসলি এমস (৮৩) এই দুজনকে সঙ্গে নিয়ে। তবে ‘আর্নি’-র টেস্ট-জীবনের সেরা বোলিং এই ইনিংসেই – ২৭-১-১০১-৪, মার খেলেও ইংল্যান্ডের প্রথম চার ব্যাটারকে আউট তো করেছিলেন।
ঐ সফরে, তিনটে টেস্ট খেলে ৩৪.৫০ গড়ে তিনি ১০টা উইকেট নেন, আর ১৮টা প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ মিলিয়ে ৩৩.৪১ গড়ে ৩৪টা উইকেট পান। Wisden-এর কথায়, “(He) toured England in 1938 as the lone spearhead of an Australian attack based on spin in the persons of O’Reilly, Fleetwood-Smith and Frank Ward. He had a fearsome reputation for high pace, which Bradman himself gently encouraged before the team arrived, but the tour was not over before some expressed the view that he was the most overrated bowler to visit England.”
ওহো, বলতে ভুলেই গেছিলাম যে ১৯২৬ সালে মেলবোর্নের (১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত) খানদানী রিচমন্ড ক্লাবে ক্রিকেট-জীবন শুরু করা ‘আর্নি’ নাকি প্রথমে একজন উইকেট-রক্ষক ছিলেন। একদিন নেট-প্র্যাকটিসের একটা ঘটনা তাঁর ক্রিকেট-জীবনের রাস্তা বদলে দেয়: “While the lad was having a bowl in the Second XI net he drew the attention of the skipper of the First XI, the much experienced Les Keating. To quote the newsletter of the club, ‘Les noted the extreme speed generated by a lethal right arm and how uncomfortable the batsmen were. Keating remarked that Ernie’s days as a wicketkeeper were over, Richmond had a new fast bowler and as early as 1929 he was opening the bowling for Victoria. Up to his last state game in 1938-39 he represented the state 43 times taking 134 wickets.’ The lad went by the name of Ernest Leslie McCormick.”
১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ১২টা টেস্ট-ম্যাচ খেলে ‘আর্নি’-র সংগ্রহ মাত্র ৩৬টা উইকেট, গড় ২৯.৯৭, সেরা বোলিং ৪/১০১ (ইনিংসে) ও ৭/১৭৩ (ম্যাচে), ইকনমি ৩.০৭, স্ট্রাইক-রেট ৫৮.৫ – খুবই সাধারণ, নিঃসন্দেহে।
আচ্ছা, আপনাদের (মানে যাঁরা দাঁতে দাঁত চেপে এতটা অবধি পড়েছেন – কেউ আদৌ পড়েছেন কী, সম্পাদক-মশাই ছাড়া!) আশ্চর্য বা বিরক্ত লাগছেনা, এই ‘আর্নি’-বৃত্তান্ত পড়তে! এত ক্রিকেটার থাকতে ইনি কেন? কারণ আছে – রচনার প্রথম দৃশ্যটা একবার মনে করুন বা ফিরে দেখুন। আর সঙ্গে এই ছবিটাও দেখুন – এটা সেই ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ট্রফি, যেটা তৈরি করেছিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, এই ‘আর্নি’ ম্যাককর্মিক, পেশায় যিনি ছিলেন একজন “Instrument-maker and Jeweller” [Wisden] – এবার বুঝলেন তো!
শেষ কথাটা বলি – আজ আর্নেস্ট লেসলি ম্যাককর্মিক-এর জন্মবার্ষিকী। ১৯০৬ সালের ১৬ই মে তারিখে জন্মগ্রহণ করা (এবং ১৯৯১ সালের ২৮শে জুন চিরবিদায় নেওয়া) এই ব্যক্তিটি আজও জুড়ে আছেন – বিশ্ব-ক্রিকেটের দ্বিতীয় বিখ্যাততম (প্রথমটা অবশ্যই সেই ‘Ashes Urn’) এই ট্রফির সঙ্গেই শুধু নয়, স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, রিচি বেনো, অ্যালান ম্যাকগিলভ্রে এমন সব ক্রিকেট-ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। কালের অমোঘ নিয়মে এক এক করে এঁরা সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু ছ’দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ট্রফির পরম্পরা বয়ে চলেছে আজও।