এ প্রশ্নের উত্তর যদি কেউ সহজে জানতে চান, তা হলে আর সৌরভ গাঙ্গুলির বিরোধী কোনও মন্তব্যই করা উচিত নয়। সেই কবে মহিন্দার অমরনাথ বাদ পড়ার পর বেঙ্গালুরুর হোটেল ওয়েস্ট এন্ড-এ বিষোদ্গার করতে গিয়ে জাতীয় নির্বাচকদের জোকার হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তারপর ইতিউতি চিমটি কাটার পর্ব চললেও বোর্ড সভাপতি, সচিব বা অন্য পদাধিকারীদের উদ্দেশে সেভাবে আক্রমণাত্মক হননি কেউই। গত চল্লিশ বছরে যে সব অধিনায়কের কাছাকাছি যেতে হয়েছে পেশার কারণে, তাঁদের মধ্যে আছেন সুনীল গাভাসকার, কপিলদেব, দিলীপ বেঙ্গসরকার, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, শচীন তেন্ডুলকার, মহেন্দ্র সিং ধোনি — এঁরা কেউই প্রকাশ্যে বোর্ড সভাপতিকে ‘মিথ্যেবাদী’ হিসাবে চিহ্নিত করতে চাননি। ওই তালিকায় বীরেন্দ্র শেহবাগ, সৌরভ গাঙ্গুলি, রোহিত শর্মাদেরও রাখতে হবে। অধিনায়কদের সঙ্গে বোর্ডকর্তাদের টুকটাক মনোমালিন্য যে হয়নি, তা বলি কী করে? অল্পবিস্তর হয়েছে। কিন্তু বোর্ড আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে, বোর্ডের তৈরি করা মঞ্চে দাঁড়িয়ে (বা বসে) বোর্ড সভাপতিকে মিথ্যেবাদী বলার মতো ধৃষ্টতা, সাহস, অসৌজন্য দেখাননি কোনও অধিনায়ক। এরপর, নেটিজেনরাই বলুক, বিরাটের ঢিলের বদলে সৌরভ গাঙ্গুলি পাটকেল ছুড়ে কী অন্যায় করেছেন? নিজের জন্য না হলেও, বোর্ড সভাপতির চেয়ারের কৌলীন্য ধরে রাখার জন্যও তো প্রতিবাদ করতে হত।
সৌরভের হয়ে জবাব দিয়েছেন নির্বাচক সমিতির চেয়ারম্যান চেতন শর্মা। এবং তারপর একপেশে হয়ে-যাওয়া মামলা ক্রমশ সৌরভের অনুকূলে চলে আসতে শুরু করে। তাঁর এবং দলের ভালর জন্য সৌরভ বলেছিলেন, টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপের নেতৃত্বের দায়িত্ব যেন না ছেড়ে দেন বিরাট। কিন্তু বিরাট পরিষ্কার জানালেন, এ রকম অনুরোধ বা পরামর্শ তাঁকে কেউ দেয়নি। চমৎকার! ব্যাপারটা অনেকটা জটিল ও ঘোলাটে হয়ে যায় চেতন শর্মা পরিষ্কার করে দেওয়ার পরও। এখনও ওই বিতর্কের জল কিন্তু থিতিয়ে যায়নি। সময় লাগবে। দুজন বুদ্ধিমান লোকের মতবিরোধ কিন্তু সহজে মিটবে না। শুরুর দিকে একপেশে হাওয়ায় বিরাট অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। আমজনতার ধারণা ছিল, সৌরভ মিথ্যে বলছেন। বরাবর যেমন বোর্ড সভাপতির প্রতি আমাদের বঙ্গসমাজের গরিষ্ঠ অংশের দুর্বলতা আছে, ছিল এবং থাকবে, তবুও শুরুর দিকে পাল্লাটা বিরাটের দিকে ভারী হয়েছিল। দিন যত এগিয়েছে, সৌরভের হয়ে গলা ফাটানোর জন্য একে একে অনেককেই আসরে নামতে দেখা গেল। আমার ধারণা, যত দিন যাবে তত বিরাট বনাম সৌরভের লড়াইয়ে অপসারিত অধিনায়ক আরও কোণঠাসা হয়ে ল্যাজেগোবরে পরিস্থিতিতে পৌঁছে যাবেন।
ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান। এ সব বলা হয়। আমাদেরও গলা উঁচু করে স্বীকার করে নিতে কোনও দ্বিধা নেই। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, এমন সফল অধিনায়ক থাকা সত্ত্বেও মহেন্দ্র সিং ধোনিকে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। পরিসংখ্যানের ভোট বিরাটের বাক্সে থাকা সত্ত্বেও। কেন তাঁর নেতৃত্বে ভারত একবারও কোনও বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি — এ প্রশ্ন আমরা নাই বা তুললাম। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো আসরে, অধিকাংশ ম্যাচে তাঁর ব্যাট যে নিষ্প্রভ থেকেছে, এটা কি, চাইলেও আমরা অস্বীকার করতে পারব? তাঁর নেতৃত্বে শিবিরে যে গুমোট আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল, এটাই বা ভুলে গেলে চলবে কেন? ক’দিন আগে এরাপল্লী প্রসন্ন বেঙ্গালুরুতে নিজের বাড়িতে বসে বলে দিলেন, ‘বোর্ড সভাপতি তো প্রতিশোধের রাস্তায় নেমেছে। এটা ঠিক নয়।’ পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘বিরাট যে এত বড় মিথ্যে কথা বলে ফেললেন, সেটা কি তিনি ঠিক করেছিলেন?’ পাল্টা আক্রমণে যেতেই প্রসন্নর মতো ধুরন্ধর স্পিনার আমতা আমতা করে বললেন, ‘তা অবশ্য ঠিক।’
এটা কুস্তির আসর নয়। এমনকি ডব্লু ডব্লু এফ-ও নয়। ক্রিকেট খেলার মর্যাদাকে উপযুক্ত জায়গা দিতে তো পারেননি বিরাট, উল্টে খেলাটার গায়ে কালি লাগাচ্ছিলেন মিথ্যে কথা এবং অহেতুক আমিত্ব রোগে ভুগতে গিয়ে। সময় করে বিরাটভক্তদের বলব, একটু বিশদে খবর নিন, তা হলে বোঝা যাবে বিরাট নিজের স্বার্থে কী কী কাণ্ড করে যাচ্ছিলেন অধিনায়ক হিসাবে। এই পরিস্থিতিতে বোর্ড সভাপতি হিসাবে সৌরভ শুধুই ঢিলের বদলায় পাটকেল ছুড়েছেন।