টেস্ট ব্যাটিংয়ে স্ট্রাইক রেট এবং নব্বইয়ের আজহার

১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসের এক সকাল। ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্টের তৃতীয় দিন। প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার ৪২৮ রানের জবাবে ভারতের রান ৭ উইকেটে ১৬১। একদিকে দাঁড়িয়ে অনিল কুম্বলে। আগের দিন ছোট পেয়ে অবসৃত হয়েছেন সদ্য অধিনায়কত্ব খোয়ানো মহম্মদ আজহারউদ্দিন। কিন্তু ইডেন দেখল, দলের বিপর্যয়ের মধ্যে ব্যাট হাতে প্যাভিলিয়ন থেকে কলার একটু তুলে নামলেন আজহার। পরবর্তী দুই ঘন্টায় ইডেন সাক্ষী থাকল এক দক্ষযজ্ঞের। নন্দন কাননে দক্ষযজ্ঞও বলা চলে। ৭৭ বলে ১৮টি চার এবং একটি ছয় সহ ১০৯ রানের ইনিংসে ফলো অন বাঁচল। এমন কি ব্যবধানেও কমানো গেলো প্রথম ইনিংসে।  

মহম্মদ আজহারউদ্দিন ছবি সৌজন্যে: উইকিমিডিয়া কমন্স

আজকাল টেস্ট ম্যাচের স্ট্রাইক রেট নিয়েও এত মাতামাতি হচ্ছে। ধরে খেলার মানসিকতার বদলে শুরু থেকেই চালিয়ে খেলার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে এই মানসিকতার আমদানী করেন আজহার। আশির দশকে কপিল দেব, সন্দীপ পাতিল, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তও এই প্রবণতা দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তা কখনই আজহারের তুল্য স্ট্রাইক রেটে নয়। 

১৯৯০ সালে ইংল্যান্ড সফর। লর্ডসে মুখোমুখি ভারত ও ইংল্যান্ড। ইংরেজ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচের দুই ইনিংস মিলিয়ে ৪৫০+ রান এবং কপিল দেবের চারটে ছয় মেরে ফলো-অন বাঁচানোর আড়ালে চাপা পড়ে যায় একটি ইনিংস। 

রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সেই বিখ্যাত “মিয়াঁ কাপ্তান বানোগে”র ঘটনা কয়েকদিন আগে ঘটে গেছে। নতুন অধিনায়ক আজহার টসে জিতে ফিল্ডিং নিলেন। এরপর গুচের ত্রিশতরানের সুবাদে রানের পাহাড়ে চড়ে বসে ইংল্যান্ড।  ফলো-অন বাঁচানোর লড়াই থেকে অনেক দূরে ভারত। নতুন অধিনায়ক এই অবস্থায় নেমে হয়তো একটু ধরবেনা ধরে খেলবেন এমনটি তাবৎ ক্রিকেটবোদ্ধারাও ভেবেছিলেন। কিন্তু বাস্তব হল সম্পূর্ণ উল্টো। পাল্টা আক্রমণ শানালেন আজহার। চরম ব্যাটিং বিপর্যয়ের মধ্যেও ১১১ বলে ১২১ রানের একটি ইনিংস। ২২টি চারের সাহায্যে। শোনা যায়, ব্রায়ান জনস্টনের মতো ভাষ্যকার ঐ ইনিংস সম্পর্কে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডে খেলা সেরা ইনিংস। 

আসলে নয় নববইয়ের দশকে আজহারের টেস্ট ম্যাচ ইনিংসগুলির মধ্যে বড় রান পাওয়া ম্যাচগুলি প্রায় সবই অসম্ভব সংকটকালে গড়া প্রতিরোধ। বড় রানের পাহাড়ের সম্মুখে ফলো-অন বাঁচানোর লড়াই, অথবা প্রথম ইনিংসে বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে। আজহার উপলব্ধি করতেন পাল্টা মার-ই একমাত্র পথ। কিন্তু সেই প্রতি আক্রমণের সাথে মিশে থাকত নান্দনিকতা। বাঁ পায়ের উপর ভর করে ব্যাটটা একটু বেঁকিয়ে কভার ড্রাইভ বা আবার শাফল করে অফ স্টাম্পের বাইরের বলকে ফ্লিক করে বাউন্ডারিতে পাঠানো আজহারের স্বরচিত ব্যাকরণ বই।

সাথে ছিল ‘রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস’, যা একাধারে রান বাড়াতো এবং অন্যদিকে ছিঁড়ে ফেলত বোলার-ফিল্ডারদের স্নায়ু। 

লর্ডসের ইনিংসে ম্যালকম, ফ্রেজার, ক্রিস লুইসকে নিয়ে ছেলেখেলা বা ইডেনে এবং পরের টেস্ট কানপুরে ডোনাল্ড, ক্লুসনার, ম্যাকমিলানদের নিয়ে ছেলেখেলা। অথবা কেপটাউনের সেই মায়াবী দুপুর।  

ডারবানের আগের ম্যাচে লজ্জার ৬৬ অল আউটের পরের টেস্ট ছিল কেপটাউনের নিউল্যান্ডসে। টেবল মাউন্টেনের শিহরিত সৌন্দর্য্যের ব্যাকড্রপে ভেসে উঠেছে ভারতের স্কোর কার্ড। এবং সেখানেও শিহরণ। দক্ষিণ আফ্রিকার ৫২৯/৭ এর জবাবে ভারত ৫৮/৫। এলান ডোনাল্ড-শন পোলক – ল্যান্স ক্লুজনার-ব্রায়ান ম্যাকমিলানরা ভারতীয় ক্রিকেট ঐতিহ্যকে ইতিহ্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। 

একদিকে অধিনায়ক শচীন।  অপর প্রান্তে ব্যাট করতে নামলেন তিনি – মহম্মদ আজহারউদ্দিন। মাটি কামড়ে, ধরে খেলার বদলে আজহার শুরু করলেন প্রতি-আক্রমণ। উইকেটের চার ধার দিয়ে ছুটে গেলো একের পর এক শট। কমেন্ট্রি বক্সে সুনীল গাভাস্কার-ব্যারি রিচার্ডসরা বলাবলি করছেন, “নেভার  সিন আ টেস্ট ব্যাটিং ইন দিস ওয়ে”। বিদগ্ধজন ১১০ বলে ১১৫ রানের এই ইনিংসটির নান্দনিক তুলনা করেছিলেন বডিলাইন সিরিজে বিল পন্সফোর্ডের করা ৮৫ রানের ইনিংসটির সাথে। 

আসলে টেস্ট ম্যাচে আজহার ব্যাট করতে আসতেন ৫ বা ৬ নম্বরে। তখনও ভারতের টেল এন্ডাররা তেমন ব্যাট করতে পারতেন না। ১৯৯৪ অবধি তাও কপিল ছিলেন, তারপর সত্যিই আজহারকে সঙ্গত করার মতোও কেউ নেই। তাই আজহারকে দ্রুত রান তুলতেই হত।

এই প্রসঙ্গে ইংল্যান্ড-ভারতের আরেকটি টেস্টের কথা বলি। ১৯৯৩-এর এই খেলাটিও আজহারের প্রিয় মৃগয়াভূমি ইডেন গার্ডেনসে। টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়ার পর লাঞ্চের সামান্য পরে ভারতের স্কোর ৩ উইকেটে ৯৩। সচিন সবে ক্রিজে এসেছেন। আজহার এলেন ব্যাট করতে। এবং আবারও ম্যালকম-জার্ভিস-পল টেলর-ক্রিস লুইসকে নামিয়ে আনলেন ক্লাব স্তরে। দিনের শেষে ভারতের রান ছিল ৪ উইকেটে ২৬৩। এর মধ্যে আজহার ১১৪ রানে অপরাজিত। পরদিন আরও ৬৮ রান যোগ করলেন আজহার। মোট ১৮২ রান (১৯৭ বলে)। খেয়াল করলে দেখা যায়, সেই ইনিংসে আজহারের পরবর্তী ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান কপিল দেবের ১৩। অর্থাৎ পুরো লড়াইটাই ছিল আজহার বনাম ইংল্যান্ডের বোলিং। 

শেষ একটি টেস্টের কথা বলে এই প্রতিবেদন শেষ করব। ১৯৯৮ সালের বক্সিং ডে টেস্ট। ওয়েলিংটনে সকালের মেঘলা আবহাওয়ায় হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন কিউই পেসার সাইমন ডুল। ভারতের রান ৪ উইকেটে ১৬। এমতাবস্থায় আজহার ব্যাট করতে এলেন এবং ডুল-কেয়ার্নস-ন্যাশদের সামলে ১০৩ রানে অপরাজিত থাকলেন। নবম উইকেটে ভেঙ্কটেশ প্রাসাদকে নিয়ে জুটি বেঁধে ৫৮ রান যোগ করলেন।

আজহারের সংহারমূর্তির মধ্যেও ছিল ক্লাসিকিয়ানা। জন্মদিনের শুভেচ্ছা মহম্মদ আজহারউদ্দিন।