১৯৮৩-র ২৫ জুন

শিরোনামে শুধু একটা তারিখ। এরকম আবার হয় নাকি? হয় বৈকি! এই তারিখটার সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে আমাদের আগের কয়েক প্রজন্মের এবং আমাদের প্রজন্মের এক সফল স্বপ্নিল পরাবাস্তবের স্বতস্ফূর্ত উদযাপনজনিত আনন্দাশ্রু, নাচ, গান, পাগলামির ৩৯ বছরের স্মৃতিরোমন্থন। ব্যক্তিগত কোন স্মরণীয় দিনের মতই এই তারিখটা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে প্রতিটি ভারতবাসীর জীবনে। আসলে এই দিনটায় আমাদের আশার বিরুদ্ধে গিয়ে বিশ্বত্রাস লয়েড-বাহিনীকে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকাপ হাতে তুলে নিয়েছিল ভারত। মহিন্দার-কপিল-মদনলাল-বিনি-সন্দীপ তথা পুরো টিমই একসঙ্গে তৈরী করেছিল লক্ষ্যে পৌঁছে যাবার ভিত। এই দিনটা নিয়ে কিছু না লিখলে ক্রিকেটের ঠাকুররা পাপ দেন। তাই চার ছয় নয়, খুচরো সিঙ্গলস রানের মত রইল এই লেখাটা।

১৯৮৩র ৯ জুনের উদ্বোধনী ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩৮ রানে হারানো, ১১ জুনের জিম্বাবোয়েকে ৫ উইকেটে পর্যুদস্ত করা, ১৮ জুনের জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিলসম্ভব সেই ৩১ রানে অলৌকিক জয় আর ২০ জুনের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১১৮ রানে সহজে জয়, ১৩ জুনের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৬২ রানে বিশাল হার ও ১৫ জুনের ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৬৬ রানে হার সত্ত্বেও ভারতকে তুলে দিয়েছিল ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সেমি-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২২ জুন তারিখে যশপাল শর্মা (৬১ রান, ৪x৩, ৬x২), সন্দীপ পাতিল ও মহিন্দার অমরনাথকে সঙ্গে নিয়ে ৫০:৫০ ম্যাচ অনায়াসে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের জিম্মায়, ইংল্যান্ড সেদিন হেরেছিল ৬ উইকেটে। তারপর যা দাঁড়াল, ১৯৭৫ আর ১৯৭৯-তে জয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২৫ জুন ১৯৮৩ তারিখের লর্ডসের ফাইনালের গন্ডী পেরোলেই ভারতের হাতের মুঠোয় উঠবে বিশ্বকাপ, যাদের আমরা ২ বার হারিয়েছিলাম গত ৩ মাসের মধ্যেই।

তাই আশা নিরাশার প্রবল দ্বন্দ্বে দোলাতে দোলাতে ২৫ জুন ১৯৮৩ তারিখটা এসেছিল, দিনটা ছিল আজকের মতই এক শনিবার। ব্যাঙ্কে হাফ-ডে ছিল সেদিন, ছুটি ২টোয়, খেলা ছিল বোধহয় বিকেল ৩.৩০ বা ৪.০০ থেকে। অফিসার হইনি তখনো, পোস্টিং ছিল আমাদের ব্যাঙ্কের ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ শাখায়, থাকতাম হাওড়ার বাকসাড়ায়। দেহটা সময়মত অফিসে গেলেও আগের রাত থেকেই মন চলে গিয়েছিল লর্ডসে। কোনও রকমে অফিস করে বাড়ি ফেরা। শুনশান অফিসপাড়া, পথে, গাড়িতে, ট্রেনে ঘরমুখী, থুড়ি, লর্ডসমুখী, জনতা। কোনমতে বাড়ি ফিরে সাদা কালো টিভির সামনে বসে পড়া। তখন কি আর জানতাম, অসম্ভবকে সম্ভব করা একটা নিদ্রাহীন মুক্তির রাত আসছে ভারতে, ঘন্টা আটেক পরেই! খেলাশেষে যে জাদুময় আনন্দঘন মুহূর্তগুলো পরপর এসেছিল, তা অবর্ণনীয়।বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন সবাই, তখনকার মফস্বলী হিসেব অনুযায়ী বেশ বেশি রাতে। সবার চোখে আনন্দাশ্রু, পাগলের মত নাচ, গান, কার্যত কেউই ঘুমোয়নি সেই রাতে।

১৯৮৩র ২৫ জুন তারিখের বিশ্বকাপ জয়কে আজও কেউ বলেন “কাকতালীয় জয়”, কেউ বলেন “টিম এফর্টের জয়” আবার কেউ বা বলেন “অলরাউন্ড পারফর্মেন্সের জয়”। আসলে, সব শুরুরই একটা আরম্ভও থাকে। এক্ষেত্রে বাজনাটা প্রথম বেজেছিল ২৫ জুন ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ের মাস তিনেক আগে, ২৯ মার্চ ১৯৮৩ তারিখে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বিসে ওডিআই সিরিজের ২য় ম্যাচে, “আমরাও পারি” নামক বিশ্বাসের তেলে প্রথম সলতে পাকিয়েছিল ভারত (৪৭ ওভারে ২৮২/৫), ২৭ রানে প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (৪৭ ওভারে ২৫৫/৯) হারিয়ে দিয়ে। সেই ম্যাচে ২৬ বলে ৩টি ঝকঝকে চারসহ ২৩ রান করা ছাড়াও রবি শাস্ত্রীর বলে ফাউদ বাক্কাসের ক্যাচ নিয়েছিলেন এক গাঁট্টাগোট্টা ভারতীয় ক্রিকেটার। ১৯৮৩-র সেই ৩ ম্যাচের ওডিআই সিরিজ ১-২ ফলে হেরেছিল ভারত আর ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ হেরেছিল ০-২ সিরিজে। ৫ টেস্টে ৯ ইনিংস খেলে ২টি অর্ধশতকসহ ২৪২ রান আর ৩ ওডিআই ম্যাচ খেলে ৫০ রান করেছিলেন সেই ভারতীয় ক্রিকেটার। এইরকমই চোখ না-টানা পারফরমেন্স করেও “টিমম্যান” হয়ে টিমের জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিতেন তখন তিনি, যশপাল শর্মা। তবু আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে। ১৯৮৩-র বিশ্বজয়ী পুরো টিমটার এই একজনই আজ আমাদের মধ্যে নেই। ১৩ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াত যশপাল শর্মাকে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে যাচ্ছি ২৫ জুন ১৯৮৩ তারিখটায়।

শুরু হল খেলা। টসে জিতে ফিল্ডিং নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তারপর? ছোট্ট করে খেলাটা ধরার চেষ্টা রইল এ লেখার নীচের অংশে।

  • সানি গাভাসকারের ১২ বলে ২ রান আর ল্যারি গোমস ও মার্শালের ২টো ক্যাচ।
  • ক্রিশ শ্রীকান্তর বিশ্বত্রাস রবার্টসকে হাঁটু গেড়ে মারা কভার-ড্রাইভ সমেত ৭টি চার আর রবার্টসকেই মারা ১টি ছয় মিলিয়ে ম্যাচের সর্বোচ্চ ৩৮ রান, ৫৭ বলে।
  • মহিন্দার অমরনাথের ৮০ বলে ৩টি চার সহ শীট-অ্যাঙ্কর রোলে ২৬, আর প্রতিপক্ষের কোমর আর লেজ ভেঙ্গে দিয়ে ৭ ওভারে ১২ রান দিয়ে দুজোঁ, মার্শাল আর হোল্ডিংয়ের ৩ উইকেট তোলা, যার সুবাদে সেমিফাইনালের মতই “ম্যান অফ দি ম্যাচ” খেতাব।
  • যশপাল শর্মার ৩২ বলে ১টি চারের সাহায্যে চাপ নেওয়া ১১।
  • সন্দীপ পাতিলের চারহীন ইনিংসে ল্যারি গোমসকে মারা ১টি ছয় সহ ২৯ বলে ২৭।
  • অধিনায়ক কপিলদেব নিখাঞ্জের ৮ বলে ৩টি চারে উজ্জ্বল ১৫, দৌড়বীর হয়ে ডিপ মিড-উইকেটে রিচার্ডসের ক্যাচ ও একস্ট্রা-কভারে লয়েডের ক্যাচ এবং ১১ ওভারে ২১ রান দিয়ে রবার্টসের উইকেট।
  • কীর্তিবর্ধন আজাদের ৩ বলে ০ রান, কোন ক্যাচ না নেওয়া আর ৩ ওভারে ৭ রান দিয়ে উইকেটহীন থেকে নিখুঁত দর্শকের ভূমিকা পালন করা।
  • রজার মাইকেল হামফ্রে বিনির ৮ বলে ২ রান, হেনেসের ক্যাচ আর লয়েডের উইকেট।
  • মদনলাল শর্মার চারহীন ইনিংসে ল্যারি গোমসকে মারা ১টি ছয় সহ ২৭ বলে ১৭ আর একমাত্র ১২ ওভারের কোটা শেষ করা ভারতীয় বোলার হিসেবে ৩১ রানে মোট ৩ উইকেট নেয়া, যার মধ্যে ছিল নির্ণায়ক রিচার্ডসের উইকেট ছাড়াও হেনস ও গোমসের উইকেট।
  • সৈয়দ কিরমানির শেষ দু’উইকেটে মদনলাল শর্মা ও বল্লু সান্ধুর সঙ্গে জুটি বেঁধে মরণপণ লড়াইয়ে ৪৩ বলে চারছয়হীন ১৪ রান করার পরে ফাউদ বাক্কাসের ক্যাচ নেওয়া।
  • বলবিন্দার সান্ধুর হোল্ডিংকে মারা ১টি চারের সহায়তায় ৩০ বলে ১১*, গ্রিনিজকে স্বপ্নের ইন-স্যুইঙ্গারে বোকা বানিয়ে বোল্ড করা ছাড়াও ফাউদ বাক্কাসের উইকেট নিয়ে ২ উইকেট, ৯ ওভারে ৩২ রান দিয়ে আর সবার আগে মার্শালের আগুনে বাউন্সারে হেলমেট হয়ে কানে তীব্র চোট পেয়েও দু’জনকে দুবার সহানুভূতিমূলক সহায়তা করা থেকে বিরত করা ও তার পরেও শেষ উইকেটে সৈয়দ কিরমানির জুটিতে সাহসী প্রতিরোধে ২২ রান, সবই নির্ণায়ক ছিল।

১৯৮৩-র ২৫ জুন তারিখে চাপের মুখে বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভেঙ্গে পড়া আর ভারতের সেদিন থেকে চার বছরের জন্য ক্রিকেটের সর্বোচ্চ শিখরে আবাহন, এসবই যেন ছিল নিয়তিনির্দিষ্ট। আমার মতে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ ছাড়াও সেদিন টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলবিন্দার সান্ধুর মার্শালের বাউন্সারে হেলমেট হয়ে কানে চোট পেয়েও সাহসসুন্দর প্রতিরোধ আর সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা দু’জনকে দুবার ফিরিয়ে দেওয়া, তারপরে শেষ উইকেটে কিরমানি-সান্ধুর ঐ মরিয়া প্রতিরোধ। তর্কের অবকাশ রেখেই লিখছি, ওখানেই আধমরা হয়ে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা। পরে তাদের ব্যাটিংয়ের সময় ভারতকে “উড়িয়ে দেবার মানসিকতায়” ভিভের ব্যাটিং কপিলদেবের স্বপ্নের ক্যাচে শেষ হওয়ার পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মহিন্দার অমরনাথের বোলিং পেনিট্রেশনের সামনে আত্মসমর্পণ করে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য হয়। কপিলদেবের নেওয়া ভিভের ক্যাচ, মহিন্দারের সফল বোলিং আর আনসাং হিরো বলবিন্দার সান্ধুর মার্শালের বাউন্সারে হেলমেট হয়ে কানে চোট পাওয়াটাই যেন ছিল এ ম্যাচের “টার্নিং পয়েন্ট”।

এ ছাড়া ওই জয়ের পিছনে ছিল ১৮৩-র পুঁজি নিয়েও জয়ের জন্য সতীর্থদের আত্মবিশ্বাসী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে অধিনায়কের ডাক দেওয়া, সতীর্থদের তাতে সাড়া দেওয়া, টিমএফর্ট এবং মরার আগে না মরার প্রতিজ্ঞা পালন। পরে সানি মজা করে বলেছিলেন “ফাইনালে আমার করা ২ রানেরও গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ১৮৪র জায়গায় ১৮২ টার্গেট থাকলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর একটু কম চাপে থাকত।” এটা ছিল নিছকই মজা।

১৯৮৩-র ২৫ জুন ছিল প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতা। তাই, তর্কাতীত না হলেও আমার মতে, দ্বিতীয় বার বিশ্বকাপ জেতা ২০১১-র ২ এপ্রিলের আগেই থেকে যাবে সেটা। সেই সময় নানা দিক থেকে অস্বস্তিতে আর চাপে থাকা একটা দেশ সেদিন এক হয়ে গিয়েছিল ১৪ জন ক্রিকেটারকে ঘিরে, দেশপ্রেমের মুক্ত আকাশের উচ্ছল সামিয়ানার নীচে। অসম্ভবকে সম্ভব করা একটা মুক্তির রাত এসেছিল ভারতে সেদিন। ভারত কার্যত ঘুমোয়নি সেই রাতে। সবার সঙ্গে মুক্তি উদযাপনের সেই রাতটা সারা জীবনে ভুলব না কারণ সেই রাতটা জীবনে আর আসবেওনা কোনদিন।

৩৯ বছর আগের একটা স্বপ্নের দিন-রাতের স্মৃতিচারণ তো সেই তারিখটা, মানে ১৯৮৩র ২৫ জুনের নামে করাই যায়, তাই না?