ঘরের শত্রু বিভীষণ, নাকি জন্মভূমিতে জমজমাট ‘জালওয়া’?

গতমাসে, অর্থাৎ ২০২২ সালের ৪ঠা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানে অস্ট্রেলিয়া বনাম পাকিস্তানের তিন-ম্যাচের বেনো-কাদির টেস্ট সিরিজের খেলা টিভিতে দেখতে দেখতে একটা পুরোনো কথা মাঝেমাঝেই মনে পড়ছিল, একজন ব্যাটারকে দেখে – নাঃ, বাবর আজম নয়। জানতে চান তিনি কে? তাহলে কিছুটা পিছিয়ে যাই, প্রায় ১৭ বছর আগে।

মনে করিয়ে দিই দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৫ সালের ৩০শে জানুয়ারি থেকে ১৩ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ইংল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার সাত-ম্যাচের দ্বিপাক্ষিক ওডিআই সিরিজের কথা। একজন নবাগত (সবেমাত্র গোটা-চারেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ-খেলা) ইংরেজ ব্যাটার সাতটা ম্যাচে ছ’বার ব্যাট করবার সুযোগ পেয়ে করলেন: ২২*, ১০৮*, ৩৩, ৭৫, ১০০* ও ১১৬ – মোট ৪৫৪ রান, গড় ১৫১.৩৩, স্ট্রাইক-রেট ১০৫.৫৮ – যেন ‘দ্বিতীয়’ জন্ম হ’ল কেভিন পিটার পিটারসেন (ওরফে “কেপি”) নামক এক তারকার যাঁর ‘প্রথম’ জন্ম হয়েছিল ১৯৮০ সালের ২৭শে জুন নাটালের পিটারমারিৎজবার্গ শহরে।

ছবি : ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ থেকে

কেপি কেন কুড়ি বছর বয়সে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে তাঁর মায়ের মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে চলে গিয়ে ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন নটিংহ্যামশায়ার-এর হয়ে, ২০০৩ মরশুমের শেষে হ্যাম্পশায়ার-এ চলে যান – সে এক অন্য কাহিনী। তার জায়গা এখানে নয়। এখানে মূল কথা যেটা উল্লেখ করতে চাই তা হচ্ছে যে তাঁর জন্মভূমির বিরুদ্ধে তিনি কেমন খেলেছেন। একনজরে সেটা দেখা যাক: ১০ টেস্টে ৮১৭ রান, গড় ৪৫.৩৮, তিনটে শতক, দু’টো অর্ধ-শতক; ১৭ ওডিআইতে ৬৪৬ রান, গড় ৬৪.৬০, স্ট্রাইক-রেট ১০০.৯৩, তিনটে শতক, দু’টো অর্ধ-শতক – রীতিমতো জমজমাট, যদিও ঐ ২০০৫ সালের ওডিআই সিরিজটার তুলনায় কিঞ্চিৎ ফিকেই লাগে। তবে তাঁর জন্মভূমিকে সুযোগ পেলেই তিনি দেখিয়েছেন তাঁর ‘জালওয়া’।

ফিরে আসি গোড়ার কথায়। সেই ব্যাটার আর কেউ নন, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা পাকিস্তান-জাত প্রথম ক্রিকেটার উসমান তারিক খোয়াজা, যিনি “উসি” নামেই বেশি পরিচিত তাঁর সহ-খেলোয়াড়দের কাছে। এই সদ্যসমাপ্ত টেস্ট সিরিজে তিন ম্যাচে পাঁচবার ব্যাট করবার সুযোগ পেয়ে উসি করলেন: ৯৭, ১৬০, ৪৪*, ৯১, ১০৪* – মোট ৪৯৬ রান, গড় ১৬৫.৩৩ – চারটে শতক হ’তে পারত, হ’ল দু্টো। জন্মভূমিতে প্রথমবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নেমে ক্রিকেট-দুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘দেশবাসী’-দেরও তিনি মুগ্ধ করলেন – গদ্দাফিতে তৃতীয় টেস্টের চতুর্থ দিনের দুপুরে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি যখন শতরানের মুখে, তখন টিভিতে দেখছিলাম গ্যালারিতে কয়েকজন স্থানীয় দর্শক ব্যানার দোলাচ্ছেন – সেই ব্যানারে লেখা, “Khawaja Mere Khawaja, 100 Bana Jaa” – উসি আশা করি সেটা দেখে খুশি হয়েছিলেন, শত হলেও জন্মভূমিতে ‘জালওয়া’ দেখানোর তৃপ্তিই আলাদা।

ছবি : ইন্টারনেট থেকে

এই সফরের অল্প কিছুদিন পরেই, এপ্রিলের গোড়ায়, মুম্বইতে দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ান অল-রাউন্ডার এবং আইপিএল-২০২২ প্রতিযোগিতায় দিল্লি ক্যপিটালস দলের বর্তমান সহকারী কোচ শেন ওয়াটসন উসি সম্বন্ধে বলেছেন: “Usman Khawaja has always been one of our best batters and one of the highest skilled batters in Australia and I could never believe when he wasn’t picked. It’s awesome what he is doing now, but for me it is actually a bit sad that we have missed an opportunity in the previous four or five years to be able to see that version of him playing for Australia. He has never lost his skills and has probably got better skills now than he ever had. I am absolutely stoked for him and so glad he got an opportunity towards the back end of his career to prove himself – he really deserves it.

প্রসঙ্গত জানাই যে অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচকমন্ডলী ২০১৯-এর আগস্ট মাসে, ইংল্যান্ডে অ্যাশেজ সিরিজের হেডিংলি টেস্টের পর (তিন নম্বরে ব্যাট করে ছ’ইনিংসে ১২২ রান সংগ্রহকারী) খোয়াজা-কে দল থেকে বাদ দেন এবং অস্ট্রেলিয়ায় ২০২১-২২ মরশুমের অ্যাশেজ সিরিজের সিডনি টেস্টের আগে পর্যন্ত তিনি দলের বাইরেই থাকতে বাধ্য হন। ফিরে এসে টেস্ট-জীবনে প্রথমবার পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে সিডনিতে করেন ১৩৭ ও ১০১* – প্রমাণ করেন তাঁর adaptability, কিন্তু হোবার্টে পরের (এবং সিরিজের পঞ্চম-তথা-শেষ) টেস্টে ওপেন করতে নেমে ব্যর্থ হন (৬ ও ১১)। তাই ওপেনার হিসেবে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে খানিক সন্দেহ জেগে উঠেছিল, তবে পাকিস্তানের সাম্প্রতিকতম সিরিজে ওপেন করেই তিনি এই বিশাল সাফল্য পেলেন – ফলে সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়-জীবনে ১৪টা ইনিংসে ওপেন করে তাঁর চারটে শতক ও চারটে অর্ধ-শতক হয়ে গেল।

টেস্ট-জীবনে এক নম্বর থেকে ছ’নম্বর সব জায়গাতেই ব্যাট করলেও [যদিও চারে কেবল একটা, পাঁচে মাত্র দুটো ও ছয়ে শুধু তিনটে ইনিংস তাঁর আছে] উসি কিন্তু মূলত ওয়ান-ডাউন ব্যাটার, ৬৬টা ইনিংসে (মোট ৮৬টার মধ্যে) সেখানেই খেলেছেন, করেছেন ছ’টা শতক ও বারোটা অর্ধ-শতক। কিন্তু ২০১৯ অ্যাশেজ সিরিজে ‘concussion substitute’ মার্নাস লাবুশেন-এর অসাধারণ উত্থানের পর সেই জায়গাটা তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছে, উসি টেস্ট-একাদশে আপাতত ওপেনার হয়েই রয়েছেন।

২০১১ সাল থেকে টেস্ট-জীবন শুরু করলেও দলে নিয়মিত জায়গা না-পাওয়া / না-রাখতে-পারা উসি এ যাবৎ খেলেছেন ৪৯টা টেস্ট, মোট রান ৩,৬৩৮, গড় ৪৭.২৪, ১২টা শতক ও ১৬টা অর্ধ-শতক সমেত। কিন্তু মধ্য-পঁয়ত্রিশের এই বাঁ-হাতি ব্যাটার এখনও নিজের খেলার ধরণে ক্রমোন্নতি করে যাচ্ছেন (শেন ওয়াটসনের জবানিতে “better skills“) – স্কোয়্যার-ড্রাইভ, কভার-ড্রাইভ, অফ-ড্রাইভ খেলতেন আগেও দেখেছি, সঙ্গে পেসারদের বিরুদ্ধে পুল-শট আর স্পিনারদের বিরুদ্ধে রিভার্স-স্যুইপ ও স্টেপ-আউট ক’রে লফ্টেড-শট সাম্প্রতিক সিরিজে অনেকবার খেলতে দেখলাম, অনেক রানও পেলেন সেইসব শট থেকে।

আসলে, ছোটবেলাতেই পরিবারের সঙ্গে জন্মভূমি [১৯৮৬ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ইসলামাবাদে তাঁর জন্ম] ছেড়ে পরদেশে-যাওয়া মানুষরা বোধহয় কিছুটা এমনই হয়ে যান – নিজেদের ক্রমাগত এগিয়ে নিতে নিজেদের বদলাতে থাকেন – আর সুযোগ পেলে ছেড়ে-আসা জন্মভূমিকে নিজেদের ‘জালওয়া’ দেখান। সবশেষে, একনজরে দেখা যাক পাকিস্তানের বিপক্ষে উসি কেমন খেলেছেন: ৮ টেস্টে ৯৯২ রান, গড় ৯৯.২০, তিনটে শতক, ছ’টা অর্ধ-শতক – এর মধ্যে আছে ২০১৮ সালের অক্টোবরে দুবাইতে ওপেন করে ম্যাচ-বাঁচানো দু’টো ইনিংসও (৮৫ ও ১৪১) – কিন্তু জন্মভূমিতে তাঁর প্রথম খেলা ২০২২ টেস্ট-সিরিজে উসি যেন ২০০৫-এর সেই কেপি-র সঙ্গেই সমানতালে পাল্লা দিয়েছেন।