আইপিএল ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ে অকপট ঋদ্ধিমান সাহা

কালীঘাট ক্লাবের আসল নেট যখন বৃষ্টিভেজা, তখন ঋদ্ধিমান সাহাকে দেখা গেল কংক্রিট নেটে তিন খুদে ক্রিকেটারকে ব্যাটিংয়ের বিভিন্ন ধরণ শেখাচ্ছেন। কখনো সোজা ব্যাট দিয়ে লফ্টেড শট খেলা বা ফ্রন্টফুট ডিফেন্স – সবই রয়েছে সেই প্রশিক্ষণের মধ্যে। এরপরে জলকাদা পেরিয়ে যখন তাঁবুতে ঢুকছেন তিনি তখন প্রায় দশ-বারোজনের ছবির আবদার মেটালেন এবং অফিস থেকে আসা চিঠির উত্তর দিয়ে যখন একটু ফাঁকা হলেন তখন একবার ইন্টারভিউ করার কথা বলতেই বসে গেলেন একটি চেয়ার নিয়ে। প্রায় দশ মিনিট বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন অক্লেশে।
প্রশ্ন:- এই বছর আইপিএলে একটা সম্পূর্ণ নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে তুমি গিয়েছিলে। মানিয়ে নিতে কতদিন সময় লেগেছিল?
ঋদ্ধিমান:- প্রথমত আমি পনেরো বছর আইপিএল খেলছি। তিন-চারটে টিমের সাথে থেকেছি। তাই এই বছর অসুবিধা হবে, এমন কোন ব্যাপার ছিল না। নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি বলতে খেলোয়াড়দের হয়তো আগের মরশুমে তাদের দল তাদের ছেড়ে দিয়েছে বা আনসোল্ড ছিল তারা। সেই জায়গায় প্রত্যেক খেলোয়াড় একে অপরকে ব্যাক করেছে। তাই হয়তো ভালো হয়েছে।


প্রশ্ন:- প্রথম চেন্নাই সুপার কিংস ম্যাচ তোমার ভালো যায়নি একেবারেই। কিভাবে পরের ম্যাচে ফিরে এলে?
ঋদ্ধিমান:- এখন সবাই যদি সব ম্যাচে ভালো খেলে তবে তো ভগবান ধরনের ব্যাপার। ব্যাট ধরবে আর পঞ্চাশ-একশো করবে, এটা তো এক বলের খেলা যে একটা বলে ভুল করলেই আউট। এটা টিমগেম। এগারোজনের মধ্যে ছয়-সাতজন অবদান রাখে এবং তিন-চারজন সব ম্যাচে ফ্লপ হয়। তার মধ্যে আমি একজন ছিলাম। দল ব্যাক করেছে এবং তারপরে সেটা টিমের জন্য এবং আমার জন্য ভালো হয়েছে।
প্রশ্ন:- জসপ্রীত বুমরা, উমেশ যাদব, সিমোরজিৎ সিং – এঁদের তুমি সহজেই ভালো পুল শট খেলছিলে। কোনরকম স্পেশাল কাজ করেছিলে পুল ভালো খেলার জন্য?
ঋদ্ধিমান:- পুল শটের জন্য আমি এই কালীঘাট ক্যাম্পে প্লাস্টিক বা টেনিস বলে প্র্যাক্টিস করেছিলাম, এখানকার কোচেরাই বল ছুঁড়েছিলেন। এছাড়া ওখানেও প্র্যাক্টিস করেছি সেই কারণে শটটা ভালো খেলতে পেরেছি। প্র্যাক্টিসে অনেকবার প্র্যাক্টিস করলে ওই শটটা ম্যাচে গিয়ে খেলতে ভালো পারা যায়।
প্রশ্ন:- ইডেন গার্ডেন্সে কোয়ালিফায়ার ম্যাচে ফার্স্ট ওভারেই আউট হলে। ঘরের মাঠ বলে কোন খারাপ লাগা ছিল?
ঋদ্ধিমান:- না। যেহেতু ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলছি তাই আমার ঘরের মাঠ মোতেরা ছিল। আমি যখন কেকেআর খেলি তখন ইডেন আমার হোম ছিল এবং কিংস ইলেভেন খেলার সময় মোহালি আমার হোম ছিল। হ্যাঁ, ছোট থেকেই এখানে খেলেছি কিন্তু এখানে হয়তো একশো ম্যাচও খেলিনি। হ্যাঁ, জানা-পরিচিত আছে তবে তোমাকে মাঠে গিয়ে রান করতে হবে।
প্রশ্ন:- শুভমান গিলের সঙ্গে তোমার বোঝাপড়া খুব ভালো ছিল। এটা নিয়ে কি বলবে?
ঋদ্ধিমান:- ওর যেরকম খেলার স্টাইল তাতে ও একটু সময় নেয় এবং ক্রিকেটীয় ধরণে বেশী খেলে আর আমার হচ্ছে ইনফিল্ডের ওপর দিয়ে খেলতে পছন্দ করি। আমার মনে হয় রোজ হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু কিছু কিছু দিন গ্যাপ দিয়ে চার হয়ে যায়। আমি এটা ডোমেস্টিক বা ক্লাব লিগেও করে থাকি এবং এছাড়াও চেষ্টা করেছিলাম ভালো পার্টনারশিপ তৈরী করার।
প্রশ্ন:- স্পিনারদের তুমি খুব ভালো খেলো। কিন্তু এই আইপিএলে স্পিনারদের সামনে একটু অফ বরং পেসার ভালো খেলেছ। কী কারণ বলবে?
ঋদ্ধিমান:- বলতে পার আমি পেসার যখন খেলেছি সেটা হয়তো পাওয়ার-প্লের ভেতরে এবং তার পরেই স্পিনাররা চলে আসে এবং তারপরে নির্দেশ যা থাকে যে ওভারে ৬-৭ এলেও উইকেট না পড়ে। সেই সময় চেষ্টা করতাম এক এক করেই খেলার। সেই কারণে হয়তো স্পিনারদের বিরুদ্ধে হয়তো স্ট্রাইক-রেট অতো ভালো নয়।
প্রশ্ন:- দ্বিতীয় চেন্নাই সুপার কিংস ম্যাচে প্রথম ওভারে ইনসাইড এজ, টপ এজ লাগে। এই ব্যাপারটা কি কিছুটা নার্ভাস করে দিয়েছিল?
ঋদ্ধিমান:- না, নার্ভাস করেনি। আমি জানি উইকেট স্লো ছিল এবং ১৩৪-১৩৫ এমন রান যে তুমি যদি শুরু ভালো না করো তবে উইকেট পড়বে এবং পরের ব্যাটারদের জন্যও কঠিন হবে। তাই যেহেতু সার্কেল ছিল এবং ঐখানে যদি ৪০-৫০ হয় তবে পরের দিকে যেই থাকুক তার পক্ষে সোজা হবে। আমি নিজের স্বাভাবিক খেলাই খেলেছি।
প্রশ্ন:- কানপুর টেস্টে ঘাড়ে টান লাগা কতটা যন্ত্রনা দিচ্ছিল?
ঋদ্ধিমান:- দিচ্ছিল বলেই আমি সোজা হয়ে খেলতে পারছিলাম না। ইনজেকশন নিয়ে খেলেছিলাম।
প্রশ্ন:- সাইড অন স্টান্স নিয়ে কিছু শট তো ব্লকড ছিল।
ঋদ্ধিমান:- হাফভলিই ব্লকড ছিল কারণ আমার ঘাড় সামনে যাচ্ছিল না। ওরা সামনে বল করেছে আমি ডিফেন্স করেছি, সাইডে কিছু শট খেলেছি।
প্রশ্ন:- এই ৬১ রানের ইনিংস কিন্তু একেবারেই সহজ ছিল না, এতো লিমিটেশন নিয়ে।
ঋদ্ধিমান:- আমি দলের জন্য এর আগেও এরকম ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস খেলেছি। তাই জানা আছে যে কিভাবে কী করতে হবে। বোলাররা চেষ্টা করবেই যখন আমি আনকমফর্টেবল জায়গায় আছি সেখানে বল করার। সেই করতে গিয়ে কিছু ভুল তারা করবেই, সেগুলো কনভার্ট করলে রান আসে।
প্রশ্ন:- ২০১৫ সালে মধ্যপ্রদেশের সাথে ৯২ রানের ইনিংস খেলেছিলে যেটা বাংলাকে অবনমন বাঁচায়। শেষ দিনের প্যাটসিদার সাথে পার্টনারশিপ নিয়ে কী বলবে?
ঋদ্ধিমান:- সেটা মনে হয় আমার বেঙ্গলের হয়ে খেলা অন্যতম সেরা ইনিংস। সেটা মনে হয় আমরা আড়াই সেশন আমরা একসাথে খেলি। সেটা প্যাটসিও মনে রাখবে হয়তো এবং আমিও মনে রাখব। একটা পয়েন্ট দরকার ছিল এবং সেটাই করতে পেরেছিলাম।
প্রশ্ন:- ইরানি ট্রফির ডাবল হান্ড্রেড যখন করেছিলে তখন পূজারার সঙ্গে কিরকম বোঝাপড়া ছিল?
ঋদ্ধিমান:- আমি প্রথম যখন খেলতে যাই তখন খেলার ধরণ যা ছিল আমার,আমি প্রথম ইনিংসে নিজের মতো খেলিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে যখন ব্যাট করতে যাই তখন ৬০ না ৭০ রানে ৪ উইকেট ছিল এবং ৩৮০ তাড়া করছিলাম। আমি পূজারাকে গিয়ে বলি যে আমি আমার মতো করে খেলবো? তখন ও বলে যে তুই তোর মতো খেল, অসুবিধা নেই। এই জন্যই হয়তো এতো ফ্রিলি খেলতে পেরেছি।
প্রশ্ন:- টেস্ট ক্রিকেটে আট নম্বরে তোমার ৪৩ ব্যাটিং গড়।
ঋদ্ধিমান:- তাই?
প্রশ্ন:- হ্যাঁ। এটা মার্ক বাউচার, ড্যানিয়েল ভেত্তরির থেকেও সম্ভবত বেশি।


ঋদ্ধিমান:- আমি তুলনায় কখনোই বিশ্বাসী নই। স্ট্যাট নিয়ে ঘাঁটিও না। আমার হয়তো ১,৫০০ মতো (১,৩০০) রান আছে আর ৩০ গড় আছে। সেটা হয়তো আরও ভালো হতে পারতো যদি নিজের জন্য খেলতাম, টিমের জন্য না খেলতাম। ছোট থেকেই টিমের জন্য খেলাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। ভাইটাল সময়ে হয়তো মেরেছি যেটা না করলেও হতো।
প্রশ্ন:- না মারার ব্যাপারে মনে পড়ে এডিলেড টেস্টে নাথান লায়নকে লং অফ দিয়ে ছয় এবং সুইপে চার আসার পরে আবার মারতে গিয়েছিলে। টিম নির্দেশ ফলো করে?
ঋদ্ধিমান:- না, টিম ইন্সট্রাকশন নয়। যখন ব্যাট করতে গিয়েছিলাম তখন ৭০ রান বাকি ছিল এবং উইকেটে টার্ন, বাউন্স সব হচ্ছিল বলে, যে কোনো সময়ে উইকেট পড়তে পারত। একা বিরাটের পক্ষে রান করা কঠিন ছিল। বিরাট বলেছিল মারার বল পেলে মেরে দিস কারণ রান তুলতে হবে। সেখানে আমি ২৫-৩০ রান করে দিলে টিমের সুবিধা হতো। তাই একটা চার-ছয় মারার পরে হয়তো ধরে খেলতে পারতাম কিন্তু মনে হয়েছিল ওই বলটা মারতে পারতাম কিন্তু লাগেনি।
প্রশ্ন:- কোনো আফসোস হয় ওই শটের জন্য?
ঋদ্ধিমান:- না।
প্রশ্ন:- অল দ্য বেস্ট পরের মরশুমের জন্য।
ঋদ্ধিমান:- ধন্যবাদ।