(১)
আসলে আমরা সবাই তো যে যার পরিসরে “দ্বাদশব্যক্তি”, যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে গেলে “প্রথম একাদশ” বাগড়া দেয়। পড়ার লাইন বা চাকরী বা ব্যবসা বেছে নেওয়া থেকে কোভিডের ভ্যাকসিনেশন, সব কিছুতেই আমরা নিছকই “দ্বাদশব্যক্তি”। সকালের আলতো আলোয় ফুটে ওঠা ছোট্ট একটা ফুল বা বিকেলের ঘনকালো মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টির মত আমরা কেউই “প্রথম একাদশ”য়ের সদস্য হতে পারিনি। বোর্ড, কর্তৃপক্ষ থেকে রাষ্ট্র প্রতি মুহূর্তে এটা বুঝিয়ে দেয় ঘাড় ধরে।
ম্যাচে ক্যাচ ওঠে, পড়ে যায়, কেউ কেউ ধরেও ফেলে অবশ্য। ধরে ফেলে যারা, তারা চেষ্টা করে “প্রথম একাদশ”-এ ঢুকে যেতে। আর মতি নন্দীর সৃষ্ট চরিত্র তারক সিংহর মত যারা তা ফেলে দেয়, তারা চেনাজানা কেউ খেলা দেখতে চাইলে “এ খেলাটা থাক। পরে একটা খেলায় নিয়ে যাব” বলাতেই অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকে। যারা তাও পারেনা, তারা সব দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোনটাই না খুলতে পারা থুড়থুড়ে বুড়ো হয়ে যাওয়া টাইপরাইটিং শেখানো ইনস্ট্রাকটার, শিলকাটার বা ভিস্তিওয়ালার মত “মাঠের বাইরে” চলে যায়। সেই সব মানুষের মুখগুলি দেখতে “মরচে ধরা টিনের কৌটো”র মত হয়ে যায়। তারা চাকরীতে জর্জরিত হয়ে সময়ের আগে তা ছেড়ে দিয়ে সগর্বে বলতে পারেনা “আর রিটায়ার করাতে পারবে না”।
২০১০ সালের ১০ জুলাই অসীম অনন্তে লিখতে চলে যাওয়া মানুষটি তারও প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগে প্রথম ছবিটির মত এইভাবে শুরু করেছিলেন বাংলা ভাষায় তাঁর একটি “আইকনিক সৃষ্টি”। “দ্বাদশব্যক্তি” হওয়ার যন্ত্রণা মতি নন্দী নিজে না উপলব্ধি করলে এরকম একটা সৃষ্টি (আত্মকথন) বাংলা সাহিত্য হয়ত পেত না।
(২)
মতি নন্দীর ১৯৬৮-র “দ্বাদশব্যক্তি” থেকে এবার চলে আসি এক মেঘলা, অন্ধকার শনিবার, ২৪ মার্চ ১৯৯০-এর ইডেনে। বেলা দেড়টা নাগাদ ব্যাঙ্ক কেটে বছর বত্রিশের আমি দৌড় দিয়েছিলাম ইডেনের দিকে। ১৯৮৯-৯০র বাংলা বনাম দিল্লী রণজি ফাইনালের ২য় দিনের খেলা দেখতে। বাংলার ঘোষিত নেতা ছিলেন সম্বরণ ব্যানার্জী। আর “নাথিং অফিসিয়াল অ্যাবাউট ইট” নেতা ছিলেন অরুণলাল।
আমি পৌঁছনোর পরে পরেই দিল্লীর ১ম ইনিংস শেষ হয়েছিল ২৭৮-এ, ১০০.৪ ওভার খেলে। কোশেন্ট ২.৭৬। বাংলার ইনিংসের গড়ে ওঠা ছিল শুরু থেকেই খুব ধীরে ধীরে, কোশেন্টে চোখ রেখে। আজও মনে আছে, ইন্দুভূষণ রায় ফেরেন নিজের ৭ রানে। নামেন অরুণলাল। আর একটু বাদেই নিজের ১১ রানে আউট হয়ে যান আর এক ওপেনার প্রণব রায়। বাংলা হয়ে গেল ২ উইকেটে ২৩। জাঁকিয়ে বসছেন দিল্লী পেসার জুটি মনোজ প্রভাকর-অতুল ওয়াসন। এই সময় প্যাভিলিয়ন থেকে বেরিয়ে আসেন ছোট্টখাট্ট এক তখনও-১৮-না-ছোঁয়া তরুণ, যাঁর রণজি অভিষেক ম্যাচ ছিল সেটা।
তারপর ছোট্ট কিন্তু দীপ্ত একটা ইনিংস। অরুণলালের মাঝ-পিচে এসে বারবার দেওয়া সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ৪টে ৪ দিয়ে সাজানো পাল্টা মার দেওয়া ঝকঝকে ২২, দিনের শেষে। যেটা ঘোষণা করে “আমি এসে গেছি”। ঐ পড়ন্ত বিকেলের বুক চিতিয়ে মার এবং তার দ্বারা প্রভাবিত নাছোড় অরুণলাল-রাজা বেঙ্কট জুড়িই তখন ভারতীয় ক্রিকেটে কুঁকড়ে থাকা বাংলাকে ৫১ বছর পরে আবার রণজি ট্রফি এনে দিয়েছিল কোশেন্টে, ঐ বারবার বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের শেষে (বাংলা ২১৬/৪)।
আজও আমার কাছে সেদিনের সেই তরুণ মানে ঐ ২৪ মার্চ ১৯৯০-এর পড়ন্ত, মেঘলা, প্রায়ান্ধকার, পরাকাষ্ঠার পরীক্ষা নেওয়া ইডেন-বিকেলে মনোজ-অতুলকে পাল্টা মার দেওয়া ৪টে ৪-এ সাজানো ঝকঝকে সেই ২২, যেটা আজও আমাকে জানিয়ে দেয়, সাহস আর সদিচ্ছা থাকলে সব হয়, এমনকি কালো অসময়ের দিনকালেও।
(৩)
তার অনেক পরে ১১ জানুয়ারি ১৯৯২-এ হবে তাঁর এক ম্যাচের জন্য ভারতের হয়ে ওডিআই অভিষেক, তার ৪ বছর পরে ২০ জুন ১৯৯৬-এ হবে টেস্ট অভিষেক, প্রথম ২ টেস্টে করবেন শতরান, মার্চ ২০০০-এ হবেন পাকাপাকি অধিনায়ক, টিমকে গড়াপেটার অপমান থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবেন রাহুল-শচীন-কুম্বলেদের নিয়ে, বুক চিতিয়ে দেশে-বিদেশে জেতাটাকেই নিয়ম করে দেবেন, ২০০২-এর ১৩ই জুলাই ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনাল জিতে (দলের বৃহত্তম স্ট্রাইক রেট থাকবে তাঁরই) লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শরীর থেকে টিম জার্সি খুলে ওড়াবেন, দল থেকে বাদ পড়বেন চ্যাপেল জমানায় নভেম্বর ২০০৫-এ, টিমে ফিরে আসার জারি থাকা লড়াইয়ের অঙ্গ অ্যাসিড-টেস্ট সম আসামের বিরুদ্ধে একটি রণজি ম্যাচের পূর্বাহ্ণে গোটা বাংলাকে বেঁধে ফেলবেন তাঁর জন্য প্রার্থনায় এবং সফল হবেন, ২০০৬-এর ডিসেম্বরে টিমে ফিরে আসবেন আগুনে পুড়ে ফিনিক্স পাখি হয়ে, শেষ পর্যন্ত চ্যাপেলকেই উড়িয়ে দেবেন, তারপর অবসরেও যাবেন নাগপুরে, ২০০৮-এর ১০ নভেম্বরে, তার আগে ১১৩টি টেস্টে অর্জন করবেন ১৬টি শতরান আর ৩৫টি অর্ধশতরানসহ ৭,২১২ রান ও ৩২টি উইকেট, আর ৩১১টি একদিনের ম্যাচে করবেন ২২টি শতরান আর ৭২টি অর্ধশতরানসহ ১১,৩৬৩ রান ও নেবেন ১০০টি উইকেট, সিএবি-র যুগ্ম সম্পাদক হবেন জুলাই ২০১৪তে, জুলাই ২০১৫ থেকে হবেন সিএবি-র সভাপতি, ঐ পদে থাকবেন অক্টোবর ২০১৯ অবধি এবং অবশেষে বিসিসিআই সভাপতি হবেন ২৩শে অক্টোবর ২০১৯ তারিখে। এগুলো ছিল, আছে, থাকবে, নিয়মমাফিক।
(৪)
কিন্তু ওই ১১ জানুয়ারী ১৯৯২ থেকে ২০ জুন ১৯৯৬, এই ৪ বছর ৫ মাস ৯ দিনের সৌরভ গাঙ্গুলীর খোঁজখবর খুব বেশি কারো ঝুলিতে নেই। প্রথম পরিচ্ছেদের “দ্বাদশব্যক্তি” হবার যোগ্যতাও তখন তাঁর ছিলনা, পরিস্থিতির চাপে। সেইখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তৃতীয় পরিচ্ছেদের “অর্জন”গুলির পিছনে ছিল তাঁর নিজেকে তুলে আনাকে “পাখির চোখ” করে ফেলা অর্জুনসুলভ ফোকাসে বারবার মার খেতে খেতে ফিরে এসে পাল্টা মার দেওয়া।
আসলে সৌরভ গাঙ্গুলী মানে শুধুই ব্যাটে-বলে অসীম সাফল্য বা অলৌকিক অধিনায়কত্বে কাদা থেকে টিমকে টেনে তুলে আনাই না, সৌরভ গাঙ্গুলী মানে বারবার মার খেতে খেতে ফিরে এসে পাল্টা মার দেওয়া পাশের বাড়ির ছেলের দৌলতে বাঙালীর “আমরাও পারি” বিশ্বাসটা ফিরে পাওয়া। বাংলার খেলাধুলোর “বাপি বাড়ি যা রূপকথা” হয়েই থেকে গেছেন সৌরভ গাঙ্গুলী।
(৫)
১০ই নভেম্বর, ২০০৮। সেদিন শেষবারের মত দেশের হয়ে খেলতে নামলেন সৌরভ। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নাগপুর টেস্টের পঞ্চম দিন (ভারত সেই টেস্ট জিতেছিল ১৭২ রানে)। এর ঠিক ৮ বছর আগে, ২০০০ সালের একই তারিখে জীবনে প্রথমবারের জন্য ভারতের অধিনায়ক হয়েছিলেন সৌরভ।
অধিনায়ক ধোনি সেই ২০০৮য়ের ১০ নভেম্বরের শুরুতেই তাঁকে বলেছিলেন অধিনায়কত্ব করতে। তিনি গররাজি ছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার নবম উইকেটের পতনের পর ফের সৌরভকে আরেকপ্রস্থ অনুরোধ করেন ধোনি [সৌরভের আত্মজীবনী অনুযায়ী: ”As the match drew to a close, Mahendra Singh Dhoni asked Dada to lead the side for one final time, as the Indian cricket fans bid goodbye to an iconic batsman and captain. However, there was more to this incident than what played out on our television screens”.]।
এবার আর ধোনির অনুরোধ ফেরাত পারেননি সৌরভ। জীবনের শেষ টেস্টে আবার অধিনায়ক হলেন তিনি এবং অস্ট্রেলিয়ার শেষ উইকেট পড়ার আগে পর্যন্ত তিন ওভারের মতো অধিনায়কত্ব করেন [সৌরভের ভাষ্য অনুযায়ী: “As the match came to a close, Mahendra Singh Dhoni in a surprise gesture asked me to lead. I had rejected his offer earlier in the day, but could not refuse a second time. Ironically, my captaincy career had begun exactly eight years ago on this very day. I handled the bowling changes and field placements while the last Australian wicket batted,” he said. However, Dada handed the captaincy back to Dhoni after just 3 overs. But I must admit, at that stage, I found it difficult to focus. So after three overs I handed it back to Dhoni saying, it is your job, MS. We both smiled.“]
এবং এসবের পরেও “সৌরভ বনাম ধোনি” ডুয়েলের চালচিত্র গতকাল আর আজ সামাজিক মাধ্যমে রাজত্ব করেছে, করবে।
সেদিন নাগপুরের বিষণ্ণ যাই-যাই বিকেল বা ছুঁই-ছুঁই সন্ধেয় নিভে-আসা সূর্যের শেষ আলোর মধ্যে সহ-খেলোয়াড়দের কাঁধে চড়ে মাঠ ছেড়ে শেষবারের মত সাজঘরে মিলিয়ে গিয়েছিলেন সৌরভ। তার সঙ্গে সেদিন সাজঘরে মিলিয়ে গিয়েছিল অসংখ্য ভারতবাসীর চোখে দেখা মার খেতে খেতে ফিরে এসে পাল্টা মার দেওয়া পাশের বাড়ির ছেলের রূপকথাও।
সেই রূপকথা সাজঘরে মিলিয়ে যাবার আগে অবশ্য ভারতীয় ক্রিকেটের ঠাকুরমার ঝুলির আর্কাইভে চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয়ে গেছে।
এইরকম একটা অসম্ভব-পেরোনো স্বপ্নসম্ভব স্ক্রিপ্ট লেখা হয়ত ভারতের অস্কারজয়ী বাঙালী পরিচালকের পক্ষেও দুঃসাহসিক হত।
(৬)
আজ ৫০-এ পা রাখলেন সৌরভ গাঙ্গুলি।
ইতিমধ্যেই ২০২১ সালের মৃদু হৃদযন্ত্রের গোলযোগকে “বাপি বাড়ি যা” করে স্বমহিমায় তিনি খেলে চলেছেন জীবনের পিচে। এই খেলা চলতে থাকুক “দাদাগিরি”র মাধ্যমেই। বাঙালী জীবনের ম্যাচে সারাজীবন যিনি “প্রথম একাদশে”ই থেকে যাবেন।
জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা, সৌরভ “দাদা” গাঙ্গুলিকে।