আর একটা ধরলেই ম্যাচ-প্রতি গড় হয়ে যেত দুই

শূন্য রান দিয়ে হায়দ্রাবাদে শুরু আর তিন রান দিয়ে কলকাতায় শেষ; টেস্ট-জীবনে কোনওমতে এক হাজার রানের মাইলফলক (১,০৬৮ রান) পেরিয়েছিলেন, ব্যাটিং গড় টেনেটুনে পঁচিশ; ষাটের কাছাকাছি গড়ে ১৮টা মাত্র উইকেট নিয়েছেন। এহেন এক অল-রাউন্ডার? মুচকি হাসবেন বহু ক্রিকেট-বোদ্ধা (বিশেষত যাঁরা এই শতকের), হাসির কারণও অবশ্যই আছে। তবে ‘কহানি’-র বাকিটা জেনে নিলে হয়ত সেই হাসিটা বন্ধ হয়ে চোখ দুটো ঈষৎ বিস্ফারিত হতেও পারে!

এবার একটা তালিকা দিই – মূলত টেস্ট-ব্যাটারদের [এঁদের অনেকেরই নাম হয়ত আপনারা শুনেছেন বা পড়েছেন; আর আপনারা যাঁরা ষাটের কাছাকাছি বা ষাট পেরিয়েছেন, এঁদের বেশির ভাগকেই তাঁরা হয়ত ভারতের মাটিতে খেলতেও দেখেছেন ষাটের দশকের একদম শেষে বা সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে।] – অস্ট্রেলিয়ার বিল লরি, কিথ স্ট্যাকপোল, ইয়ান চ্যাপেল. ডাগ ওয়াল্টার্স, পল শিহান; ইংল্যান্ডের ব্রায়ান লাকহার্স্ট, ব্যারি উড, ডেনিস অ্যামিস, ডেভিড লয়েড, মাইক ব্রিয়ার্লি, মাইক ডেনেস, কিথ ফ্লেচার, টনি লুইস, টনি গ্রেগ, বেসিল ডি’ওলিভিয়েরা, অ্যালান নট; ওয়েস্ট ইন্ডিজের রয় ফ্রেডেরিক্স, রোহন কানহাই, ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, ডেরিক মারে – জনা কুড়িরও বেশি, তাই না? এঁদের ‘শিকার’ করতে পারা – অনেককে একাধিকবার, কাউকে কাউকে তিন-চারবার – যেকোনও টেস্ট-ক্রিকেটারের কাছে বুক ফুলিয়ে বলবার মতই বটে, বিশেষত সেটা যদি হয় একগুচ্ছ রক্ষাকারী আবরণ (মানে হেলমেট, প্যাড এইসব) ছাড়াই ব্যাটারের সঙ্গে হাত-মেলানো দূরত্বে দাঁড়িয়ে। স্ট্যাকপোল, চ্যাপেল, ওয়াল্টার্স, অ্যামিস, গ্রেগ, নট এঁদের মতন স্ট্রোক-প্লেয়ারদের ব্যাটের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে এই ভদ্রলোকটিকে ইডেনে ফিল্ডিং করতে আমি দেখেছি।

রসিকতা করে আগে বলা হ’ত যে দলের দ্বাদশ-ব্যক্তিকে হতে হবে তুখোড় ফিল্ডার। তো সেই হিসেবে সর্বকালের ভারতীয় টেস্ট-দলে দ্বাদশ-ব্যক্তির অন্যতম জোরালো দাবিদার এই ক্রিকেটারটি যিনি ২৭টা টেস্ট খেলেই (৫০টা ইনিংসে) ৫৩টা ক্যাচ ধরেছিলেন, অর্থাৎ ম্যাচ-প্রতি প্রায় দুটো (১.৯৬) করে ক্যাচ – প্রখ্যাত ক্রিকেটীয় ওয়েব-সাইট http://www.howstat.com/cricket/statistics/fielding/FieldingCareerCatches.asp?Stat=3 বলছে টেস্টে কমপক্ষে পঞ্চাশটা ক্যাচ ধরেছেন (উইকেট-রক্ষক ছাড়া) এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বপ্রথম – আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনি হলেন শর্ট-লেগ ফিল্ডিংয়ের অধীশ্বর একনাথ সোলকার, আর তাঁর পেছনে রয়েছেন স্লিপ-ফিল্ডিংয়ের সব তারকারা – ববি সিম্পসন, স্টিভ স্মিথ, স্টিফেন ফ্লেমিং, মার্ক টেলর, রস টেলর, গ্রেম স্মিথ, মার্ক ওয়, গ্রেগ চ্যাপেল, ইয়ান চ্যাপেল প্রভৃতিরা; এই তালিকার পরবর্তী ভারতীয় রাহুল দ্রাবিড় অনেক পেছিয়ে, ২২ নম্বরে। 

ছবি : ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ থেকে

নিজের ক্রিকেট-জীবনের দ্বিতীয় সিরিজেই ১৯৬৯-৭০ মরশুমে দেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চারটে টেস্টে ১০টা ক্যাচ ধরে সাড়া জাগিয়েছিলেন, তার মধ্যে ইডেনে চতুর্থ টেস্টের দ্বিতীয় দিনে বেদির বলে লরির ক্যাচটা নিয়ে তখনকার দিনে আলোড়ন পড়ে গেছিল, এটা আমার আজও মনে আছে। তারপর ১৯৭১ সালে ভারতের দ্বৈত বিদেশ-বিজয়-অভিযানে (ওয়েস্ট ইন্ডিজে পাঁচটা ও ইংল্যান্ডে তিনটে) আটটা ম্যাচে ১৪টা ক্যাচ উনি ধরেন, আর সঙ্কটের মুখে গোটা-পাঁচেক অতি-প্রয়োজনীয় হাফ-সেঞ্চুরির ইনিংস খেলে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ আখ্যাও অর্জন করেন। ওভাল টেস্টের চতুর্থ দিনে ভেঙ্কটের বলে নট-এর ক্যাচটাকে (সঙ্গের ছবি) সেই সময়কার সেরা ক্লোজ-ইন ক্যাচগুলোর মধ্যে ধরা হয়।

দেশের মাঠে ১৯৭২-৭৩ মরশুমে ইংল্যান্ডের  বিরুদ্ধে পাঁচটা টেস্টে ১২টা ক্যাচ, এবং ১৯৭৪-৭৫ মরশুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে চারটে টেস্টে আটটা ক্যাচ ধরেছিলেন। ভারতের স্পিন-চতুষ্টয়ের দাপটের পেছনে ঐ সময়ে বছর-কয়েকের জন্য “এক্কি” ছিলেন এক স্তম্ভবিশেষ।

১৯৭৬ সাল থেকেই ওঁর ফর্ম খারাপ হতে শুরু করে এবং ১৯৭৬ / ১৯৭৭ সালে আর মাত্র দুটো টেস্ট খেলেই কেবলমাত্র ২৯ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তাঁকে অবসর নিতে হয়, যদিও আরো চারটে মরশুম তিনি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেছিলেন। উনি মারা যান মুম্বাইতে ২৬শে জুন, ২০০৫ সালে, ৫৭ বছর বয়সে।

একনাথ সোলকরের জন্ম-তারিখ (১৮ই মার্চ, ১৯৪৮ সাল) উপলক্ষ্য করে এই সামান্য স্মৃতিচারণা।