কার্তিককে আর বুড়ো বলবেন না

প্রায় এক বছর আগের কথা। ভারত সেবার টেস্ট সিরিজ খেলতে গেছে ইংল্যান্ডে। দীনেশ কার্তিকও গেলেন। তবে অন্য ভূমিকায়। তিনি গিয়েছিলেন ধারাভাষ্য দিতে।
সাধারণত ক্রিকেট জীবনে ইতি টেনে খেলোয়াড়রা ধারাভাষ্যে আসেন। তিনিও নিশ্চয় এখন থেকেই কমেন্ট্রি বক্সে ইট পেতে রাখছেন। এমন জল্পনা হওয়াই স্বাভাবিক। সত্যিই তো, যে লোকটা ২০০৪ থেকে টেস্ট খেলছেন, যে লোকটা জীবনের শেষ টেস্ট খেলে ফেলেছেন ২০১৮ সালে, যাঁর বয়স তখন পঁয়ত্রিশ প্লাস, তাঁকে ঘিরে কে আর খামোখা স্বপ্ন দেখতে যাবেন!‌ তাঁকে অতীত ধরে নেওয়াটাই স্বাভাবিক।


গত এক বছরে ভারতীয় ক্রিকেটে এমন অনেকেই অবসর ঘোষণা করলেন যাঁরা দেশের হয়ে শেষ খেলেছেন আট বছর, দশ বছর আগে। বিস্মৃতির অতলেই চলে গিয়েছিলেন। ঘটা করে অবসর ঘোষণা না হলেই লোকে জানতেই পারত না, এতদিন তাঁরা খেলতেন। এ অনেকটা ‘‌কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’‌ গোছের।
তবে দীনেশ কার্তিক কিন্তু শুধু ধারাভাষ্য দিতে যাননি। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেট সরঞ্জাম। অর্থাৎ, নিজের প্র্যাকটিসও চালিয়ে যাবেন। এই নিয়ে কম বিদ্রুপ শুনতে হয়নি। তিনি কিনা আবার ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছেন!‌ ঘটা করে ইংল্যান্ডে ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস, হেলমেট বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের ছোটবেলায় কেউ কেউ পিকনিকে যাওয়ার সময় অঙ্ক বই নিয়ে যেত। যেন সেখানে গিয়ে অঙ্ক কষে ফাটিয়ে দেবে। গিয়ে দেখা যেত, হুল্লোড়ের মাঝে ব্যাগের বই ব্যাগেই রইল। তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না ঠিকই, কিন্তু আড়ালে আবডালে প্যাঁক দেওয়ার প্রথা দিব্যি ছিল। দীনেশ কার্তিককেও কি তেমন প্যাঁক খেতে হয়নি?‌ নিশ্চিতভাবেই হয়েছে।
কী আশ্চর্য, ২০২২ টি২০ বিশ্বকাপের দরজায় কিনা জোর কড়া নাড়ছেন সেই ‘‌বর্ষীয়ান’‌ কার্তিক। একদিকে হার্দিক পান্ডিয়ার মতো কেউ কেউ আছেন, যাঁরা দেশের হয়ে খেলা নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নন। আইপিএলে যে টাকার হাতছানি, তাতে দেশের হয়ে খেললেন কি খেললেন না, পরোয়াও করেন না। ঘটা করে সেসব কথা বলেও বেড়ান। অন্যদিকে দীনেশ কার্তিক। যাঁর অভিষেক হয়েছে ১৮ বছর আগে, যিনি ভারতীয় ক্রিকেটের মূলস্রোত থেকে অনেকটা দূরে, তিনি কিনা প্রত্যাবর্তনের জন্য দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছেন। একের পর এক ম্যাচে মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেই পুরনো প্রবাদটা, ওস্তাদের মার শেষ রাতে। তারপরই যখন টিভির ব্যুম তাঁকে ধরছে, দ্বিধাহীনভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‌আইপিএলে রান পাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু আমার আসল কাজ এখনও বাকি। আমার একটাই লক্ষ্য। আবার দেশের হয়ে খেলা। আবার জাতীয় দলে ফিরে আসা। তার জন্য যা যা করতে হয়, তাই করব।’‌
২০২০ মরশুমের আইপিএল খুব ভাল স্মৃতি বয়ে আনেনি। তিনি ছিলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক। মাঝপথেই তাঁকে সরিয়ে রাতারাতি অধিনায়ক করা হয় ইওয়িন মর্গানকে। সেই সরানোর পদ্ধতিটা মোটেও সম্মানজনক ছিল না। এবার তাঁকে রাখার কোনও চেষ্টাই করেনি কলকাতা। জায়গা হয়েছে ছ’বছর আগে ছেড়ে আসা বেঙ্গালুরু শিবিরে। ব্যাট করতে আসছেন পরের দিকে। ফলে, খুব বেশিক্ষণ যে উইকেটে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন, এমনও নয়। ডাক পড়ছে একেবারে শেষবেলায়, মোক্ষম সময়ে। ১২ ম্যাচে তার মধ্যেই করে ফেলেছেন ২৭৪ রান। সবচেয়ে যেটা অবাক করার বিষয়, এই ১২ ইনিংসের মধ্যে অপরাজিত ৮ ইনিংসে। ফলে, ২৭৪ রানের পথে গড় হয়েছে ঈর্ষণীয় (‌৬৮.৫০)। ‌আর স্ট্রাইক রেট!‌ সেটাও কিনা ২০০। ইতিমধ্যেই ২১ খানা ছক্কাও রয়েছে ঝুলিতে। বোঝাই যাচ্ছে, কী পরিমাণ ঝড় উঠেছে এই দক্ষিণ ভারতীয়র ব্যাটে। আইপিএলের গোড়া থেকেই তিনি খেলছেন। কিন্তু এত রানের গড় বা এত স্ট্রাইক রেট, কোনওটাই ছিল না। আগের ১৩ বছরকে যেন ছাপিয়ে গেছেন এই একটা বছরেই। তার চেয়েও বড় প্রাপ্তি বোধ হয় ‘‌ফিনিশার’‌ তকমাটা। ধোনির নামের সঙ্গে জুড়ে আছে এই তকমা। এই আইপিএলে ধোনির আড়ালে এত বছর লুকিয়ে থাকা মানুষটিও যেন হয়ে উঠেছেন বিশ্বস্ত ফিনিশার।
কিন্তু তিনি তো দিনের শেষে উইকেট কিপার। আর একটা দলে কটাই বা উইকেট কিপার থাকে!‌ ঋষভ পন্থ, ইশান কিষাণরা তো আছেনই। কিন্তু কার্তিকের এই ঝোড়ো ব্যাটিং দেখে তাঁরাও বোধ হয় খুব নিশ্চিন্তে নেই। দু’‌মাস পর আবার বকেয়া একটি টেস্ট খেলতে ইংল্যান্ডে যাবে ভারতীয় দল। সেই দলে তাঁর থাকার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু আবার কি ধারাভাষ্য দিতে যাবেন?‌ তাও এখনও পরিষ্কার নয়। যদি যান, এবারও নিশ্চিতভাবে ক্রিকেট কিট নিয়েই যাবেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এবার আর ট্রোলড হতে হবে না। বরং বেশ সমীহের চোখেই তাকিয়ে থাকবেন সবাই। কোন মাঠে তিনি চুপি চুপি অনুশীলন করছেন, সেখানে হয়ত চুপি চুপি নির্বাচকরাও পৌঁছে যেতে পারেন।