ক্রিকেটঃ সংকুচিত হতে থাকা এক মহাশক্তি?

১৮৮২ সালে অস্ট্রেলিয়া প্রথমবার ইংরেজদের তাদের ঘরের মাঠে টেস্ট ম্যাচে পরাজিত করে। বলাই বাহুল্য, এই ঘটনায় ইংল্যান্ডে হুলুস্থুলু পড়ে যায়। একটি সংবাদপত্র, স্পোর্টিং টাইমস, পরের দিন একটি ব্যাঙ্গাত্মক শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় ইংলিশ ক্রিকেট মারা গেছে, তার মৃতদেহের অস্থিভস্ম অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়া হবে।
ওভালের সেই কিংবদন্তি টেস্টে ইংরেজ দলের অধিনায়ক ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত ইংরেজ ক্রীড়াবিদ A. N. Hornby। এরপর যে ইংরেজ দল অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য নির্বাচিত হল তার অধিনায়ক Ivo Bligh ঘোষণা করলেন, তাঁর লক্ষ্য হবে দেশে অ্যাশেজ ফিরিয়ে আনা এবং অস্ট্রেলিয়াতে ম্যাচ জেতার পর কিছু মহিলা নাকি bails পুড়িয়ে সেই ছাই একটি পাত্রে করে Bligh-কে উপহার দেন। তার থেকেই নাকি Ashes Urn প্রথার উৎপত্তি।

ছবি : গুগল

জন্ম হয় অ্যাশেজ সিরিজের। আজ, প্রায় দেড়’শ বছর পরেও অ্যাশেজ টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী সংগ্রামগুলির অন্যতম। হ্যাঁ, এখনো।

এই বিশাল সময়কালে ক্রিকেটের মানচিত্র অবশ্য বেশ অনেকটা বদলে গেছে। ক্রিকেটের উপকেন্দ্র অনেকটাই সরে গেছে এশিয়ার দিকে।  

ভারতীয় উপমহাদেশে এই খেলার জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী এ কথা আমরা সকলেই জানি। এবং ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে বা শ্রীলঙ্কায় এই জনপ্রিয়তা বাড়ছে বই কমছে না। সাম্প্রতিক কালে নেপালেও ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা জারিত হয়েছে।

কিন্তু আমার-আপনার মত যারা ক্রিকেট ভালবাসে তাদের কাছে এই খেলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বস্তুত, বৃহত্তর পৃথিবীতে  ক্রিকেট প্রসারিত হওয়ার জায়গায় সংকুচিত হচ্ছে, এ মত নিয়ে অন্তত আমার কোন সন্দেহ নেই। এবং এই খেলাটির দন্ডমুন্ডের কর্তারা এ বিষয়ে কতটা চিন্তিত এ নিয়েও সংশয় রয়েছে।

কেন এ কথা বলছি? সেই ১৮৭৭ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়, অর্থাৎ দুটি টেস্ট-খেলিয়ে দল দিয়ে শুরু হয় টেস্ট ক্রিকেটের যাত্রা। এই মুহূর্তে ১২টি আন্তর্জাতিক দলকে টেস্ট স্টেটাস দিয়েছে ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি। ১৫০ বছরে ১২ তে পৌঁছেছি আমরা। অর্থাৎ, ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী ফরম্যাট খেলার  ন্যুনতম  দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে মাত্র ১২টি দেশ। এবং সেই দেশগুলির মধ্যেও খেলার মানের বিস্তর ফারাক রয়েছে। ৪-৫টি এলিট দেশ যে স্তরে টেস্ট খেলে এই মুহূর্তে সেই স্তরের ধারে-কাছে পৌছনো সম্ভব নয় বাকি দেশগুলির পক্ষে।

বিচক্ষণ পাঠক বলতেই পারেন, টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে ক্রিকেটে খেলার জনপ্রিয়তা বা মান বিচার করা উচিৎ না। বললে ঠিকই বলবেন। টেস্ট ম্যাচের দৈর্ঘ্য, এবং তাতে সফল হতে গেলে প্রয়োজনীয় স্কিল-সেট বা মানসিক  শক্তির বিকাশ  হওয়ার জন্য বহু বছরের ক্রিকেট ট্র্যাডিশনের প্রয়োজন একটি দেশে।

এ কথা বুঝতে পেরেই ক্রিকেটের ধারকবাহকরা একদিনের ক্রিকেট সৃষ্টি করেন। টেস্ট-এর আবেদন যে সারা পৃথিবীতে কখনোই ছড়িয়ে পড়বে না এটা তাঁরা জানতেন। ক্রমে বিশ্বকাপ, ক্রমে সাদা বল, দিন-রাতের খেলা, ক্রমে ২০-বিশ, ক্রমে ১০-দশ, হান্ড্রেড। আর কোনও খেলায় এত ফরম্যাট, এত পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে কি? মনে হয় না। এবং এই পরিবর্তন বা পরিমার্জনগুলি করতে হয়েছে খেলাটির জনপ্রিয়তা, আবেদন বাড়াতে।

কিন্তু এতসব কিছু সত্বেও ক্রিকেটকে ক’টি বড় দেশ গ্রহণ করেছে? চিনের মত কেউ-কেউ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, বাকি বহু দেশে এই সূক্ষ সুন্দর খেলাটির কোন প্রভাবই পড়েনি।

আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা জার্মানির ক্রিকেটের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন সেখানে ইংরেজ এক্সপ্যাট, অর্থাৎ সেই দেশে থাকা ইংরেজরাই মুলত ক্রিকেট খেলতেন। তাঁদের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না খেলাটিকে বাইরের জগতে ছড়িয়ে দেওয়ার। যেভাবে ইংরেজরা ব্রাজিলকে ফুটবল শিখিয়েছিলেন, সেভাবে কখনোই ক্রিকেটকে প্রসারিত করার চেষ্টা করেননি ইংরেজরা।

এর একটি বিশেষ সামাজিক কারণ আছে। ক্রিকেট সবসময়ই এলিটদের খেলা ছিল, ফুটবলের সঙ্গে সাম্য জড়িয়ে ছিল তার সূচনাকাল থেকেই।অপরদিকে  ক্রিকেটের সঙ্গে ইংরেজ  সাম্রাজ্যবাদের এক গভীর সম্পর্ক ছিল। খেয়াল করে দেখুন, ইংরেজ সাম্রাজ্যের অঙ্গ বেশিরভাগ দেশেই এই খেলা জনপ্রিয়। ইংলিশ ওয়ে অফ লাইফ সেখাতে ইংরেজরাই “নেটিভদের” ক্রিকেটে দীক্ষিত করেন। ইংরেজদের খেলায় ইংরেজদের হারাতে পারার আনন্দ এই দেশগুলিতে এর প্রাথমিক জনপ্রিয়তার মূল কারণ।

আবার অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা প্রাক্তন ইংরেজ কলোনি হওয়া সত্বেও ক্রিকেটকে প্রত্যাখান করেছে। তার মূল কারণ এই দেশগুলিতে বেসবলের উত্থান। অথচ এই দুটি দেশই কিন্তু ক্রিকেটের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যচ খেলে, ১৮৪৪ সালে।

ছবি : গুগল

যদিও আইসিসি উঠে-পড়ে লেগেছে উত্তর আমেরিকার বাজার ধরার লক্ষ্যে, ক্রিকেট নিয়ে মার্কিন মুলুকে (এবং কানাডায়) নিরাশক্তি কাটছে না।

প্রথম বিশ্বের কোনও দেশই ক্রিকেট খেলেনা। যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়া বাদে। এর একটি বড় কারণ ক্রিকেটের সঙ্গে ব্রিটিশনেস বা ইংরেজিয়ানার অন্তরঙ্গ যোগ। টেনিস, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিসের মত বেশিরভাগ আধুনিক খেলার জনক ইংরেজরা হলেও একমাত্র ক্রিকেটের গায়েই ইংরেজ তকমাটি লেগে আছে। যার ফলে বাকি খেলাগুলি গ্রহণ করলেও, একমাত্র নেদারল্যান্ডস বাদে ক্রিকেটকে কোনদিনই স্বাগত জানায়নি ইউরোপের বাকি দেশগুলি। কমনঅওেলথ দেশগুলির বাইরে ডাচ ভুমিতেই ক্রিকেট সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়, যার রেশ এখনও বর্তমান। 

(ক্রমশ)