প্রথমেই বলে রাখি, এই লেখাটির উদ্দেশ্য ছিল ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আলোচনা শুরু করা। তাই আজ, এটির শেষ পর্ব লিখতে বসেও, আশা করছি লেখাটির আসল কাজ সবে শুরু হল, শেষ নয়।
বলেছিলাম শেষ পর্বে ক্রিকেটের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলব। যদিও এ বিষয়টি নিয়ে এই স্বল্প পরিসরে বিশদে আলোচনা করা খুব কঠিন।
এক-কালে খেলা আয়োজিত হত, সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি সেই অনুযায়ী সবরকম ব্যবস্থা করত। আর এখন যে কোন বড় টুর্নামেন্টের সব-রকম শেডিউলিং হয় সম্প্রচারকে মাথায় রেখে।
১৯৮৩-র কপিল দেবের টানব্রিজ ওয়েলস-এ করা অমর ১৭৫এর কোন ফুটেজ নেই কারণ সেই খেলা টিভিতে দেখানোর কোন পরিকল্পনাই ছিল না। তার কারণ ৮৩-র বিশ্বকাপ ঝড়ের গতিতে খেলা হয়েছিল। একই দিনে একই সময়ে দুটি করে খেলা ফেলা হয়েছিল। তাই প্রথম থেকেই ভারত-জিম্বাবোয়ে খেলাটি না দেখিয়ে সেদিনই অনুষ্ঠিত লর্ড’স-এ অস্ট্রেলিয়া বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মহারণ দেখাবে ঠিক করেছিল সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা চ্যানেল। ভারত বা জিম্বাবোয়ে কাউকেই সম্ভাব্য বিশ্বকাপ বিজেতা হিসেবে চিহ্নিত করেনি তারা স্বাভাবিক কারণেই।
আজকের দিনে এরকম কিছু ঘটবে, মানে বিশ্বকাপে ভারত খেলবে এবং সেটা টিভি বা ইন্টারনেটে দেখানো হবে না, এটা অকল্পনীয়। ভুল বললাম, বিশ্বকাপের খেলা হবে (যে কোন দুটো দলের মধ্যেই হোক না কেন), এবং দেখানো হবে না, এটা অকল্পনীয়। আবার একটু ভুল বললাম। বিশ্বকাপ নয়, টেস্ট-খেলিয়ে দলগুলির মধ্যে কোথাও কোন একটা খেলা হচ্ছে আর সেটা দেখানো হবে না, এটাই অকল্পনীয়। সম্প্রচার ঠিক করে কখন কী খেলা হবে, এমন কী ঠিক করে দেয় টুর্নামেন্টের ফর্ম্যাট।
২০০৭-এর বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডেই ভারত ও পাকিস্তান ছিটকে যাওয়ার পর বহু টাকার লোকসান গোনে সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা চ্যানেল। আইসিসি প্রায় অস্তিত্ব সংকটেই পড়ে যায়।
পরিসংখ্যান বলে ক্রিকেট পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান খেলা দর্শকসংখ্যার ভিত্তিতে। অর্থাৎ, ফুটবলের পরেই সবচেয়ে বেশি মানুষ ক্রিকেট দেখেন। তবে ভারত-পাকিস্তান, এবং কিছুটা বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মানুষ যদি কোনও জাদুবলে ক্রিকেট দেখা বন্ধ করে দেন তাহলে ক্রিকেট কি আর ক্রিকেট থাকবে?
এই যে আইপিএল-এ বর্ষিত বিপুল ধনরাশি, যা ক্রিকেটীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি, তার উৎস আমি, আপনি, এবং আমাদের মতন অগণিত ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমী।
২০১৯-এর বিশ্বকাপ ফিরে গেল ১৯৯২-এর ফর্ম্যাটে। ১০টি দেশ একে ওপরের বিরুদ্ধে খেলার পর সেমি-ফাইনাল পর্যায় শুরু হল। এর ফলে associate সদস্য দেশগুলির ঘুড়ি তো কাটা পড়লই, অভূতপূর্ব ভাবে দু’টি টেস্ট-খেলিয়ে দেশ, আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবোয়ে, বিশ্বকাপে নামতে পারল না।
এই পরিবর্তন করা হয়েছিল কেবল মুনাফার জন্য। নিশ্চিত করা গেছিল ভারত, পাকিস্তান কমপক্ষে ন’টা খেলা খেলবেই।
পুঁজিবাদী পৃথিবীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত, কিন্তু ক্রিকেট প্রসারের পরিপন্থী।
বলা হয় এখন বিশ্বজুড়ে কুড়ি২০ লিগ খেলাটিকে বিশ্বায়নের পথে নিয়ে গেছে। কিন্তু লক্ষ্য করলেই দেখবেন সেই হাতে-গোনা টি২০ বিশেষজ্ঞরাই এই টুর্নামেন্টগুলোতে খেলেন। টি২০ লিগগুলি থেকে যে বিশাল মুনাফা হয় তা দেশে-দেশে ক্রিকেট প্রচারের ক্ষেত্রে কতটা ব্যবহার হয়?
ক্রিকেটে শক্তি ও অর্থের সাম্যের অভাব এর প্রসারের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এক-কালে এক বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক আমায় বলেছিলেন ভারতের মত ক্রিকেট-শক্তি নাকি অলিম্পিকের মত মাল্টি-স্পোর্ট ইভেন্টে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে। কারণ তাহলে অন্য বড় দেশের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ বাড়তে পারে এবং ভারতের আধিপত্য কমতে পারে। এখন অবশ্য শোনা যায় আইসিসি অলিম্পিক্সে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সদর্থক পদক্ষেপ নিচ্ছে। দেরি হয়েছে বড্ড, কিন্তু তাও এটা ঠিক সিদ্ধান্ত। এবার কমনওয়েলথ গেমস-এ মহিলাদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট রাখা হয়েছে। অনেকদিন পর এই গেমস-এ ক্রিকেট ফিরল, যদিও ক্রিকেট একটি আদ্যোপান্ত কমনওয়েলথ স্পোর্ট। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডে প্রভাবের অসাম্য এখনও বর্তমান, এবং associate সদস্য দেশগুলিতে ক্রিকেটের জন্য অর্থ লগ্নির অভাব এই খেলাটির প্রসারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এজ-গ্রুপ ক্রিকেট থেকেই কিন্তু যেকোন খেলার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করতে হয়। দুম করে একটা দেশ সিনিয়র দল নামাতে পারেনা। এবারের আন্ডার-১৯ বিশ্বকাপে উগান্ডার দলের ক্রিকেটারদের দেখে কিছুটা আশা জেগেছে। আরও উগান্ডা ক্রিকেটের প্রয়োজন।
আগেই বলেছি এই খেলাটি সূক্ষ্ম, এর সরঞ্জাম অন্য খেলার তুলনায় বেশি লাগে, এতে ব্যবহৃত বলটি শক্ত, ভুল টেকনিকে খেললে চোট আঘাতের সম্ভাবনা থাকে প্রচুর। তাই ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে তৃণমূল স্তরে অনেক বেশি কাজের প্রয়োজন। ক্রিকেটের ভেতর এক মহাশক্তি লুকিয়ে আছে, এমন শক্তি যা পৃথিবীকে জয় করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে সেই শক্তি উন্মোচন করার বদলে আমরা হাঁটছি উল্টো পথে।
এরকম চললে ভারতের মত ক্রিকেট শক্তি বনগাঁয়ে শিয়াল রাজা হয়ে উঠবে আরও প্রকট ভাবে। আরও অর্থহীন হয়ে পড়বে এই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জয়ের আস্ফালন।
১৮৮২তে ইংরেজ ক্রিকেটের ‘মৃত্যু’ ঘটেছিল, এই সংকোচন চললে হয়ত সমগ্র খেলাটিরই ‘মৃত্যু’ ঘটতে পারে।