আর লজ্জার নয়, ‘মানকাদিং’

এতদিন পরে যেন শাপমুক্তি ঘটল। ক্রিকেটের ‘স্পিরিট’ নষ্ট হচ্ছে বলে দীর্ঘকাল যে আউটের সঙ্গে বিতর্ক জড়িয়ে থাকতো, এমসিসি এতদিনে নিজেদের ক্রিকেটীয় আইন সংশোধন করে সেই বিতর্কিত বিষয় থেকে মুক্তি দিল এক ভারতীয় ক্রিকেটারকে। বিশেষ করে এই আইনটি সংশোধিত হওয়ার পরে শচীন তেন্ডুলকর পরিস্কার  জানিয়েছেন, “মানকাদিং আউটের সঙ্গে একজন ভারতীয় ক্রিকেটার ভিনু মানকাদের নাম জড়িয়ে থাকাটা আমার কোনওদিনই পছন্দ ছিল না। এই নিয়মটার বদল আমার কাছে উল্লেখযোগ্য ও উপযুক্ত বলেই মনে হয়েছে ।” এতদিন ‘মানকাদিং’ আউটটিকে ৪১.১৬ ধারা অনুসারে ‘রান আউট’ হিসাবে ধরা হলেও সেটা ক্রিকেটীয় ‘স্পিরিট’-এর পরিপন্থী হিসাবেই গণ্য করা হতো। এখন থেকে ৪১-এর (‘অনৈতিক’ খেলা) থেকে সরিয়ে সোজাসুজি ৩৮ নম্বর ধারায় (রান আউট) যুক্ত করা হল, যেখানে বলা হয়েছে, এরপর থেকে এই আউটটিকে রান আউট হিসাবেই ধরা হবে, ‘অখেলোয়াড়ি’ হিসাবে নয়।  

কী এই ‘মানকাদিং’ ?

একটূ পরিস্কার করে ঘটনাটা জানিয়ে রাখা যাক। ১৯৪৭-৪৮ অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ভারতীয় দল দ্বিতীয় টেস্ট খেলছিল সিডনিতে।বোলিং করছিলেন বাঁহাতি স্পিনার ভিনু মানকাদ। ওপেনার বিল ব্রাউন নন-স্ট্রাইকার প্রান্ত থেকে প্রায় প্রতিবারই বল ডেলিভারি করার আগেই কয়েক্ কদম এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ভিনু শেষমুহূর্তে বল ডেলিভারি না করে তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে দেখান যে “তুমি অন্যায্যভাবে বারেবারে এগিয়ে যাচ্ছো। এবার করলে আমি কিন্তু তোমাকে রান আউট করে দেবো।” ঘটনা হচ্ছে, বারণ করা সত্ত্বেও ব্রাউন একইভাবে আবার এগিয়ে যেতেই ভিনু বল হাতে ছুটে এসেও, বল ডেলিভারি না করে স্টাম্পে লাগিয়ে দিয়ে আউটের আবেদন জানান। আম্পায়ার বাধ্য হন রান আউট দিতে। জানিয়ে রাখা যাক, এর কয়েকদিন আগে অস্ট্রেলিয়ান একাদশের বিরুদ্ধে এক প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ খেলার সময়ও ঠিক একইভাবে সতর্ক করে দেওয়ার পরে ভিনু আউট করেছিলেন ব্রাউনকে। টেস্ট ম্যাচে ব্রাউনকে এই ভাবে আউট করায় অজি সংবাদ-মাধ্যমে সমালোচনার প্রবল ঝড় ওঠে (“Mankad Again Traps Bill Brown.”)।তাঁরা আউটের ধরণকে ‘মানকাদিং’ আখ্যা দিয়ে জানান, এই আউট ক্রিকেটীয় স্পিরিটের সঙ্গে খাপ খায় না। এটা ‘অখেলোয়াড়োচিত’। যদিও অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ডন ব্র্যাডম্যান কিন্তু মানকাদের আউট করার পদ্ধতির সমালোচনা তো দূরের কথা, উল্টে পরিস্কার জানিয়ে দেন আইনের আওতায় থেকে মানকাদ অনুচিত কাজ কিছুই করেননি। কিন্তু সেই থেকেই কেউ এই ধরণের আউট করলেই বলা হতো ‘মানকাদিং’ অর্থাৎ ‘অখেলোয়াড়সুলভ আউট’। এটা দেখা হতো না যে, নন-স্ট্রাইকারও কিন্তু বল ডেলিভারি করার আগেই কয়েক-পা এগিয়ে গিয়ে অন্যায়ভাবে নিজের ছোটার পথটি কমিয়ে রাখছেন।সেটাও অখেলোয়াড়সুলভ। অথচ, এরপরে অ্যাডিলেড টেস্টে ইয়ান রেডপাথকে চার্লি গ্রিফিথ, ক্রাইস্টচার্চে ডেরেক র‌্যাণ্ডেলকে ইয়ান চ্যাটফিল্ড, পার্থে সিকান্দার বখতকে অ্যালান হার্স্ট এইভাবেই আউট করেন। ওয়ান-ডে ক্রিকেটেও গ্রেগ চ্যাপেল, দীপক প্যাটেল, কপিলদেব (পোর্ট এলিজাবেথে পিটার কার্স্টেনকে), সচিত্র সেনানায়েক আউট করেন যথাক্রমে ব্রায়ান লাকহার্স্ট, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, জস বাটলারকে। টি-২০ এবং রঞ্জি ট্রফিতেও একাধিক ঘটনা আছে, যেখানে সতর্ক করে দেওয়ার পরে বোলাররা আউট করেছেন নন-স্ট্রাইকার প্রান্তের ব্যাটারদের। আইপিএল-এ কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের ক্যাপ্টেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন এইভাবে সতর্ক করে দেওয়ার পরে আউট করেন রাজস্থান রয়্যালসের জস বাটলারকে, যা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। ঘটনা হচ্ছে, মানকাদের বহু আগে ১৮৩৫ সালে সাসেক্সের জর্জ বাইজেন্টকে এইভাবে ‘প্রথম’ আউট করেন ডার্বিশায়ারের থমাস বার্কার। কিন্তু সেটা সেভাবে সামনে আসেনি। এলে, মানকাদ এবং তাঁর পরিবারসহ ভারতীয়দের, হয়ত এইভাবে অকারণ লজ্জা এতদিন বহন করতে হতো না।

                    

অবশ্য, সুযোগ পেয়েও ক্রিকেটীয় স্পিরিট মেনে কোর্টনি ওয়ালশ পাকিস্তানের শেষ উইকেটের ব্যাটার সেলিম জাফরকে আউট না করায় ১৯৮৭ বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে যেতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।