ক্রিকেটঃ সংকুচিত হতে থাকা এক মহাশক্তি?

পর্ব – ৩

একদিন একটি দুঃস্বপ্ন দেখলাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হচ্ছে ভারত বনাম কোন একটি বড় টেস্ট-খেলিয়ে দলের (মনে নেই কোন দল), কিন্তু দু’দলের সব ক্রিকেটারই দক্ষিণ এশিয়।

না, ভয় পাবেন না, এই চিত্রটি সম্পূর্ণ আমার কল্পনাপ্রসূত, কিন্তু কেন আমার মস্তিষ্ক এই উদ্ভট কল্পনা করল সেটা নিয়ে একটু পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ও প্রসার, যে দেশগুলিতে এই খেলাটি পরম্পরাগত ভাবে খেলা হয় সেখানেও কিছু ক্ষেত্রে সংশয়ের সম্মুখীন। ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডে ক্রিকেট ফুটবলের পেছনে রয়েছে জনপ্রিয়তায়। রাগবি তাকে জোর টক্কর দেয়। কাউন্টি ক্রিকেটের বিপুল আকর্ষণ এখন অতীত। হান্ড্রেড-এর আয়োজন করে মাঠ ভরানো গেলেও, সামারসেট বনাম মিডলসেক্সের লাল-বলের খেলায় মাঠে ১৫০-২০০ লোক আসাটাই স্বাভাবিক এখন। তৃণমূল স্তরে কোচ ও পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, বিশেষত লাল-বলের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এখনও ভীষণ জনপ্রিয় তার জন্মভূমিতে (বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া অথবা ভারতের সঙ্গে খেলা থাকলে), কিন্তু সমস্যা রয়েছে তার নীচের স্তরগুলিতে। বস্তুত, কাউন্টি ক্রিকেট মানুষকে টানতে পারছিল না বলেই কুড়ি২০-এর জন্ম হয়।

ইংল্যান্ডে এখন ক্রিকেট টিভিতে দেখতে হলে সাধারণ মানুষকে অনেকটাই টাকা খরচ করতে হয়, যা আগে ছিল না। ক্রিকেট ইংল্যান্ডের জাতীয় খেলা হওয়া সত্বেও ধনতন্ত্রের গেরোয় পড়ে তা সাধারণ দর্শকের ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে চলে গেছে কিছুটা। তবে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া নিয়ে এখনও সেরকম দুশ্চিন্তা করার সময় হয়ত আসেনি। অন্য কিছু টেস্ট-খেলিয়ে দেশগুলিতে সমস্যা আরও গভীরে।

ছবি ইসিবি

সম্প্রতি ভয়াবহ একটি চিত্র দেখলাম ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত একটি খেলায়। মাঠ ভর্তি দর্শক প্রায় সবাই দক্ষিণ এশিয়, কেউ-কেউ আবার ভারতীয় জার্সি পরা (না, ভারত খেলছিল না!)। অথচ ছোটবেলার ক্রিকেট-দেখার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল সেই ক্যালিপ্সো সুর, সেই স্টীল ড্রামের নির্ঘোষ। কোথায় গেলেন স্থানীয় ক্যারিবিয় দর্শকরা? 

বহু ক্রিকেট-খেলিয়ে দেশের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে অনেকদিন আগেই। ক্যারিবিয় দ্বীপ-পুঞ্জে নাকি আর বিশেষ কেউ ক্রিকেট খেলতে চায় না, সাগর পার করে আমেরিকা গেলেই  বাস্কেটবল, বেসবলের স্বপ্নের দুনিয়া সে দেশের ক্রীড়াবিদদের জন্য খুলে যায়। 

এক-কালে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বক্রিকেট তাদের অঙ্গুলিহেলনে নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমান ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল দুটি ২০বিশ বিশ্বকাপ জিতলেও তাদের পূর্বসূরিদের ধারে-কাছেও আসতে পারে না।

দক্ষিণ আফ্রিকা সম্প্রতি ভারত-কে টেস্টে হারালেও, নানা কারণে ৯০-এর দশকের শক্তিশালী প্রোটিয়াস-কে আর খুঁজে পাইনা। 

এমন কী এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে উন্নতি করেছে যে দেশ, নিউজিল্যান্ড, সেখানেও খেলাটির জনপ্রিয়তা রাগবির অনেক পেছনে। 

এই মুহূর্তে বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইয়ে (সব ফরম্যাটেই), রয়েছে হাতে-গোনা ৪ থেকে ৫টি দেশ। একটি সত্যিকারের বিশ্বমানের খেলার ক্ষেত্রে এটা কাম্য নয়। 

ছবি : আইসিসি

ক্লান্তিকর দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ভারত আজকাল প্রায় অজেয়। এই মুহূর্তে তারা হেলায় শ্রীলঙ্কাকে হারাচ্ছে। সেই শ্রীলঙ্কা যারা ১৯৯৬-তে বিশ্বকাপ জিতে অবাক করে দিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বকে। তুলনা করে দেখুন এখনকার শ্রীলঙ্কা দলের সঙ্গে রণতুঙ্গার সেই শ্রীলঙ্কা দলকে … মনে হবে ভারত-সফর করতে আসা এই দলটি তাদের পূর্বসূরিদের তুলনায় ক্রিকেট দক্ষতায় নেহাতই শিশু। অর্থাৎ ক্রিকেট শুধু যে প্রসারিত হতে ব্যর্থ হচ্ছে তাই নয়, খেলাটি সংকুচিত হচ্ছে। এর পেছনে ক্রিকেটীয় অর্থনীতি একটি মস্ত বড় কারণ। এই লেখাটির শেষ অংশে সেই বিষয় নিয়ে কথা বলব।

(ক্রমশ)