ক্যাপ্টেন্সি, উইলিয়ামসন, হার্দিক, মুহূর্তগুলো …

অধিনায়কত্ব ঠিক কেমন হওয়া উচিত?
ক্রিকেটে ক্যাপ্টেন্সি কেমন হওয়া উচিত নয় সে ব্যাপারে সেরা মন্তব্য অবশ্যই সর্বশ্রী ইয়ান চ্যাপেলের। ‘কমিটি গড়ে ক্যাপ্টেন্সি হয় না!’
বই পড়েও হয় না, প্রসঙ্গে সৌরভ গাঙ্গুলি বলেছিলেন একটি ইংরেজি শব্দ, ‘ইনস্টিঙ্কট’। বাংলায় তা দু-শব্দে প্রকাশিত — সহজাত প্রবৃত্তি।
ক্রিকেটে অবশ্য ‘ক্যাপ্টেন্সি’ অধ্যায়টা এতটাই বড় যে, এমন ছোট ছোট কিন্তু প্রবল ভাবগম্ভীর নানা ভাবনার যোগফল। আর সেখানে ভাবনা ও তার সার্থক রূপায়ণ হয়ত দাবি করবে সবচেয়ে বেশি শব্দ। কেন, বোঝাতে দুটি ঘটনা জরুরি, এই ২০২২ টাটা আইপিএল-এর।
বেঙ্গালুরু বনাম হায়দরাবাদ, গত ২৩ এপ্রিল। যেহেতু এখন আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়ই না প্রায়, ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে কোভিডরীতি মেনে একটা অস্থায়ী প্রেস বক্স তৈরি করা হয়েছে, স্টেডিয়ামের দোতলায়। তার সবচেয়ে নীচের যে ধাপ সেখান থেকে মাঠটা বোধহয় সবচেয়ে ভাল দেখা যায়। ওখানে বসে বসেই দেখছিলাম ম্যাচটা, চায়ের কাপ হাতে।


দ্বিতীয় ওভারে বল করতে এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বাঁ-হাতি জোরে বোলার মার্কো ইয়ানসেন। দ্বিতীয় বলেই ফ্যাফ দুপ্লেসি বোল্ড। এলেন বিরাট কোহলি। হায়দরাবাদের অধিনায়ক, যিনি আবার নিউজিল্যান্ডেরও নেতা, কেন উইলিয়ামসন, ডেকে নিলেন আইডেন মার্করামকে, দ্বিতীয় স্লিপে। পরের বলেই বিরাট আউট, সেই দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ দিয়ে। কাকতালীয়, মনে হতেই পারে। এখানে একটু বিস্তারিত বলা জরুরি।
ক্রিকেট ওয়েবসাইটের পাঠককে দ্বিতীয় স্লিপ কোথায় দাঁড়াবে বলতে চাওয়াটা অশ্লীলতার দায়ে পড়তে পারে। তবুও চেষ্টা। আমরা যারা টেস্ট ক্রিকেট টিভিতে দেখে এবং নিজেরাও খানিকটা খানিকটা খেলে বড় হয়েছি, জানি, উইকেটকিপারের পেছনে দাঁড়ায় ফার্স্ট স্লিপ। এমন একটা জায়গা যার বেশ খানিকটা উইকেটকিপার ‘কভার’ করে ফেলতে পারেন। যে বলে উইকেটকিপারের গ্লাভস পৌঁছয় না, ফার্স্ট স্লিপের বিশ্বস্ত হাতজোড়া থাকে। তা হলে, দ্বিতীয় স্লিপ কোথায় দাঁড়াবে?
সনাতন ক্রিকেটের নিয়ম, ফার্স্ট স্লিপে দাঁড়িয়ে একটা বৃত্তচাপ আঁকা হবে। ফার্স্ট স্লিপ (ডান-হাতি ব্যাটার ধরে) ডানহাত বাড়িয়ে দেবে, সেকেন্ড স্লিপ বাড়াতে বাঁহাত। দুটো হত পরস্পরকে ছুঁয়ে ফেলবে, এমন একটা অবস্থান আর অঙ্কের ভাষায় যা বৃত্তচাপ, সেই পরিধি ধরে। একটা গোলাকৃতি ভাব যেন ফুটে ওঠে, পাশে তৃতীয় স্লিপ দাঁড়ালে যা আরও পরিষ্কার।
চোখ আটকে গিয়েছিল তাই সেই ম্যাচে মার্করামকে দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়াতে দেখে। ব্যাপারটা হল এমন, মার্করাম আর উইকেটরক্ষক প্রায় এক সরলরেখায়। আবার সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীর অঙ্ক ক্লাসে ফিরি। সরু সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের ছবি মনে আছে? ভূমির কৌণিক বিন্দুদুটো কাছাকাছি। আর মন্দিরের চূড়ার মতো লম্বাটে দেখতে যে শীর্ষবিন্দুটি তৈরি হল, ফার্স্ট স্লিপ দাঁড়ানো সেখানে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, উইকেটকিপার আর সেকেন্ড স্লিপের মাঝে গর্তসম জায়গা, সেই গর্তে যেন লুকিয়ে আছে ফার্স্ট স্লিপ, সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দু হয়ে!
এতে কী হল? ব্যাটের কানা নেওয়া বলটা যদি প্রথম স্লিপ পর্যন্ত না যেতে পারে, আগেই মাটিতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, দ্বিতীয় স্লিপ তার এগিয়ে-থাকা এবং প্রথম স্লিপ ফিল্ডারকে ‘কভার’ করে-থাকা অবস্থানের কারণে, সহজেই পেয়ে যান ক্যাচটা। অবধারিত হল এমন। বাঁ-হাতি জোরে বোলারের বিরুদ্ধে ভুল করার ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ বিরাট একইরকম। মার্করাম ক্যাচটা নিলেন অনায়াসে। মনে রাখুন, মার্করাম ওখানে না-থাকলে ফার্স্ট স্লিপ বলটা পেত ‘ওয়ান ড্রপ’!
বিরাটের জন্য বাঁ-হাতি জোরে বোলারকে দ্বিতীয় স্লিপ দেওয়াটা পরিকল্পনার অন্তর্গত, দ্বিতীয় স্লিপকে ওই জায়গায় দাঁড় করানো ক্যাপ্টেন কেন-এর ‘ইনস্টিঙ্কট’। মনে আছে, ওখানেই ঠায় বসেছিলাম দেখতে যে, আর কোনও ব্যাটারের বিরুদ্ধে উইলিয়ামসন এমন অদ্ভুত জায়গায় দ্বিতীয় স্লিপকে রাখেন কিনা। পাইনি, কারণ দ্বিতীয় স্লিপই তো লাগেনি আর খুব বেশিবার। এক-আধবার যা-ও বা রাখা হয়েছিল, সনাতনী। অন্তত ওই বিরাট-ট্র্যাপ স্লিপ-কর্ডন কিছুতেই নয়।
আবার উল্টোটা দেখলাম হার্দিক পাণ্ড্যকে। ক্রিজে ‘পৌঁছচ্ছি’ আর ‘পৌঁছে গিয়েছি’, এই দুইয়ের মাঝখানে আসলে পৌঁছে যায় রান আউটের ক্যামেরা! মুম্বই-এর বিরুদ্ধে হার্দিক ভেবে নিলেন পৌঁছে গিয়েছেন। ওই সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ের মিথ্যে আত্মবিশ্বাসে ব্যাটটা বাড়াতে পড়িমরি ভাবটা আনতে দিল না হার্দিককে। ম্যাচটা গুজরাত থেকে মুম্বই-এর দিকে ঢলে পড়ল গত ৬ মে, ওই একই মাঠ, ব্র্যাবোর্নে।


‘ইনস্টিঙ্কট’, যা মুহূর্ত-বিশ্বাসী। প্রবৃত্তি যা সহজাত। কখনও তা একশোয় একশো, কখনও আবার শূন্য!
মাঠে-বসেই হোক বা টেলিভিশনে, এমন কত মুহূর্তের জন্ম যে দেয় টিটোয়েন্টিও!