পাঠ প্রতিক্রিয়া – “অল্পস্বল্প ক্রিকেটের গল্প”

এই বইটা কিছুক্ষণের জন্য যেন আমাকে আবার আমার সেই পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণীতে-পড়া ‘প্রি-টিন-এজ’ দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল। মনে পড়ে গেল ষাটের দশকের শেষে কেনা আমার এক প্রিয় বাংলা ক্রিকেটের বইয়ের কথা যেটা কেউ কেউ হয়ত পড়েছেন – দিলীপ দত্তের লেখা “উইকেট থেকে বাউন্ডারি”। সেখান থেকেই প্রথম জেনেছিলাম অস্ট্রেলিয়ান গ্রেড ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের তিন (আট বলের) ওভারে সেঞ্চুরি, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের শেষ-বলে টেস্ট জয়, গিলবার্ট জেসপের সেই সওয়া-এক ঘন্টায় ১০৪ রানের ইনিংস, (মরিস টেট-এর বাবা) ফ্রেড টেট-এর একমাত্র টেস্ট-ম্যাচ খেলার তিক্ত অভিজ্ঞতা – এমন সব কথা।

ক্রিকেটের নানারকম কৌতুহলোদ্দীপক ঘটনা ও তথ্য নিয়ে যেসব ক্রিকেট-প্রেমী আগ্রহী – [যাঁরা কেবলমাত্র শচীন-সৌরভ-রাহুল-মাহি-বিরাট-রোহিত-ঋদ্ধি-ঋষভ অথবা ‘বিশ-বিশ’ খেলা নিয়েই মাত্রাতিরিক্ত অত্যুৎসাহী, তাঁদের কথা অবশ্য বলতে পারবনা] – তাঁদের অবশ্যই আকর্ষণ করবে, অনেক টুকরো-টুকরো কথা জানতে পারবেন তাঁরা। 

কয়েকটা উদাহরণ দিই: নোবেলজয়ী ক্রিকেটার, আবির্ভাব-টেস্টেই প্রায় ট্রিপল-সেঞ্চুরি করা আন্তর্জাতিক ফুটবলার, পঞ্চাশ ছুঁতে চলা টেস্ট-নবাগত, মৃত্যুশয্যায় প্রিয় শিশুকন্যাকে দেখতে টেস্ট-সেঞ্চুরি করেই বিমানে উড়ে যাওয়া ওপেনার, বিভিন্ন রকম জীবিকামূলক পদবীধারী ক্রিকেটাররা, হরিয়ানার প্রথম রঞ্জি জয়, রাতের আলোয় রঙিন পোষাকে সাদা-বলের ক্রিকেটের মূল হোতা, স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ট্রফির নির্মাতা টেস্ট-ক্রিকেটার, ক্রিকেট-প্রেমিক কন্যান ডয়েলের বিখ্যাত গোয়েন্দার নাম-রহস্য, ক্রিকেটে মহিলাদের উদ্ভাবনী প্রভাব, ওপেনিং পার্টনারশিপের স্মরণে সিগারেটের নাম – গোটা ষাট-পঁয়ষট্টি এমন সব ঘটনা আজকের ইন্টারনেটের দুনিয়াতেও একত্রে পাওয়া কঠিন, বিশেষত বাংলাভাষায়।

প্রবীণ ক্রীড়া-সাংবাদিক/লেখক অশোক রায় এই চমৎকার কাজটি করেছেন বাংলাভাষী ক্রিকেট-প্রেমীদের জন্য। অনেক অভিনন্দন আমার মতন এক উৎসাহী-এবং-মনোযোগী-অথচ-স্বল্পজ্ঞানী পাঠকের তরফ থেকে। “মাতৃভাষায় ক্রিকেট-চর্চার উন্নতমানের তথ্যসমৃদ্ধ বই কোথায়?”, বাঙালি পাঠকের এইজাতীয় আক্ষেপ বা প্রশ্নের কিছু উত্তর, হাত তুলে উঠে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাষায় দেওয়ার জন্য।

সবিনয়ে জানাই তিনটি মন্তব্য – এই ধৃষ্টতা লেখক নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন এই ভরসা নিয়ে।

(১) অধ্যায়-৪ / পৃষ্ঠা-১৭: রডনি রেডমন্ড টেস্ট-অভিষেকে ১০৭ ও ৫৬ করেছিলেন, ১৫৭ ও ৫৬ নয় – সম্ভবত মুদ্রণ-প্রমাদ।

(২) অধ্যায়-৩৭ / পৃষ্ঠা-১০২: কপিলের ১৭৫ নট আউটের দিন (১৮ই জুন, ১৯৮৩) বিশ্বকাপের চারটে ম্যাচ ছিল, যার মধ্যে দুটোর টেলিকাস্ট করা হয় – অস্ট্রেলিয়া বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান, বাকি দুটোর – ভারত বনাম জিম্বাবোয়ে এবং নিউজিল্যান্ড বনাম শ্রীলঙ্কা – করা হয়নি। কারণ সহজেই বোধগম্য – জনপ্রিয়তা। কাজেই বহুপ্রচলিত ‘বিবিসি-র কলাকুশলীদের ধর্মঘট’ ব্যাপারটা সঠিক নয়। ক্রীড়া-সাংবাদিক গুলু এজেকিয়েল-এর “Myth-Busting” বইতে আছেও।

(৩) অধ্যায়-৪৬ / পৃষ্ঠা-১২৮: উইকিপিডিয়া অনুযায়ী ডোনাল্ড ডাক কার্টুন-চরিত্রটির জনসমক্ষে প্রথম আবির্ভাব নাকি ১৯৩১ (বা ১৯৩৪) সালে। ক্রিকেটের ডোনাল্ড ১৯৪৮ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘ডাক’-টি করেন। তাহলে ওয়াল্ট ডিসনি কি করে “Donald out for a duck” শিরোনাম থেকে ঐ চরিত্রটি সৃষ্টি করে ফেললেন – এটা বোধগম্য হ’লনা।

সবশেষে বলি বইয়ের কাগজ-ছাপাই-বাঁধাই-অলঙ্করণ ইত্যাদি ভাল। পৌনে-দুশোর বেশি পৃষ্ঠার বইটিতে মুদ্রণ-প্রমাদ ও বানান-ভুল সংখ্যায় খুবই কম। অর্থাৎ সম্পাদনা ও প্রুফ-রিডিংয়ের কাজে যত্নের ছাপ আছে। ছবিগুলো মূল্যবান, বিশেষত নব্য-প্রজন্মদের জ্ঞাতার্থে। বহু আগেকার (সংবাদপত্রে বা পত্রিকায় প্রকাশিত) সাদা-কালো ছবিগুলির মধ্যে কয়েকটার ছাপা বিশেষ ভাল আসেনি, কারণটা অন্তত আমার কাছে সহজবোধ্য তাই অনুযোগ করছি না।