মাঠে নেমে লাল বলে যাঁরা কখনও ক্রিকেট খেলেছেন (বা আম্পায়ারিং করেছেন), তাঁরা জানেন তাগড়া পেসারের বল কেমন ‘হুশ’ করে স্টাম্প ঘেঁসে বেরিয়ে যায় বা প্যাঁচালো স্পিনারের বল কেমন ‘সরর’ আওয়াজ করে হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ নেমে আসে অথবা বেকুব ব্যাটের কানায় লাগা বল কেমন কাতিল কিপারের গ্লাভসে ‘খপ’ করে ঢুকে যায়। এসব আওয়াজ গ্যালারিতে বা টিভির সামনে বসে শুনতে পাওয়া যায়না, সেখানে বসে পাওয়া যায় বড়জোর ব্যাটে-বলে হওয়ার ‘ঠক’ বা ‘খুট’ শব্দটা।
বেশির ভাগ বাংলা ক্রিকেট-রচনা থেকেই, তা বইতে বা ওয়েবসাইটে বা ফেসবুকে যেখানেই হোক, এই আওয়াজগুলো ‘কানে আসেনা’। কিন্তু সৌরাংশুর এই বইটার “লং স্টপের চরিত্ররা” অংশের রচনাগুলোর [২২টা রচনা, হয়তো ২২ গজের কথা ভেবেই কি?] বেশ কয়েকটা পড়তে গিয়ে যেন ঐ শব্দগুলো মাঝেমাঝেই শুনতে পেলাম – ম্যালকম মার্শাল, মনিন্দর সিং, ওয়াসিম আক্রম, উৎপল চ্যাটর্জি, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, মহেন্দ্র সিং ধোনি, ডেল স্টেন – এঁদের কথা জানতে জানতে।
মহিন্দর অমরনাথ, ভিভ রিচার্ডস, ডেভিড গাওয়ার, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, স্টিভ ও মার্ক ওয়, বীরেন্দ্র সেহওয়াগ, কেভিন পিটারসেন – এঁদের স্ট্যান্স, গ্রিপ, ফুটওয়ার্ক ও কিছু কিছু বিশেষ শট খেলার ভঙ্গিমা কখনও কখনও ভেসে উঠছিল চোখের সামনে, কোনও ভিডিও ছাড়াই। অনুভব করলাম ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে গ্রেগ চ্যাপেল কি বোঝাতে চেয়েছেন – ওঁকে নিয়ে কোনও ভারতীয়ের এই মানের লেখা কমই চোখে পড়েছে, এটুকুই বলে রাখি।
মনে পড়ে গেল মাঠের মধ্যে ডিকি বার্ডের হাঁটা-চলা, হাত-নাড়া, আউট-দেওয়া এইসব কিছু। সঙ্গে জানলাম তারক সিনহার কোচিংয়ের ধ্যান-ধারণা ও পাকিস্তানী মহিলা ক্রিকেটের ঊষালগ্নের কথা। ফিরে দেখলাম বাংলা তথা ভারতীয় ক্রিকেটে গোপাল বসু ও অরুণ লাল এই দুজনের অবদান। আর সামান্য হলেও একটু যেন বুঝতে পারলাম লেখকের জীবনে তাঁর পিতৃদেবের ‘খেলোয়াড়ি’ প্রভাব।
এই বই অনুযায়ী, আমার ‘বেশি-মন-টানা’ রচনার তালিকার চরিত্ররা হলেন – অতীন্দ্রনাথ সিংহ, গ্রেগ চ্যাপেল, ডিকি বার্ড, মহম্মদ আজহারউদ্দিন মনিন্দর সিং, ওয়াসিম আক্রম, বীরেন্দ্র সেহওয়াগ, মহেন্দ্র সিং ধোনি, কেভিন পিটারসেন ও তারক সিনহা। আর [পাকিস্তানি ক্রিকেটর প্রথম আড়াই-তিন দশক নিয়ে কিঞ্চিৎ চর্চা করা] এই অধমের কাছে নতুন একটা অধ্যায়ের পৃষ্ঠা খুলে দিল পাকিস্তানি মহিলা ক্রিকেট নিয়ে রচনাটা। এর জন্য লেখককে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই।
এবার আসি অন্যান্য খেলা নিয়ে লেখা চরিত্রগুলোর কথায় – ফুটবল, টেনিস, ব্যডমিন্টন, হকি, বাস্কেটবল, মোটর-রেসিং ও ক্যারম যাঁদের ক্রীড়াক্ষেত্র। এই রচনাগুলোর ওপর ‘খবরদারি’ করবার দুঃসাহস ও পড়াশোনা দুটোর কোনওটাই আমার নেই – আমার মোল্লার দৌড় ঐ ‘পুরুষদের ক্রিকেট’-এর মসজিদ অবধিই। তবু এঁদের দু-চারজনকে নিয়ে ‘দুইখান কতা কই’।
- চুনী গোস্বামী আমার স্কুলের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাক্তনী – তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে (আসলে তাঁর ক্রিকেটার-সত্তাকে নিয়ে) একটা ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’-গোছের রচনা লিখেওছিলাম – কিন্তু চুনী-প্রদীপ এই দুজনকে কেন্দ্র করে তাঁদের আমলের ভারতীয় ফুটবলের গৌরবগাথা আমার কাছে কখনোই পুরোনো হয়না।
- জন ম্যাকেনরো কেমন করে যে আমার প্রবল বিয়র্ন বর্গ প্রীতিকে সত্তর দশকের শেষদিকে ক্রমশ আলগা করে দিয়েছিলেন, তা আবার বুঝতে চেষ্টা করলাম। কয়েক বছর আগে পড়া ওঁর আত্মজীবনী “Serious” বইটা আবার পড়বার ইচ্ছেটা জেগে উঠল।
- সৈয়দ মোদিকে (প্রকাশ পাড়ুকোন ও পার্থ গাঙ্গুলি এঁদের সঙ্গে) দেশের হয়ে ১৯৮৩-তে নেতাজী ইন্ডোরে “Come on, Modi” ব’লে উৎসাহ-দেওয়া সুনীল গাভাস্করের ঠিক পেছনের আসনে বসে খেলতে দেখেছি। মহম্মদ শাহিদের স্টিকের জাদুর বেতার-বিবরণী ১৯৮০-র মস্কো ওলিম্পিকে মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। এঁদের কি এই শতকের ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীরা জানেন, কতজন জানেন!
- ছোট্টবেলা-থেকেই-Formula-1-রোমঞ্চরসের-রসিক আমার পুত্রের একমাত্র ‘স্পোর্টিং আইডল’ আয়ার্টন সেনা-র সঙ্গে আমার পুরোনো-অথচ-রেসিং-না-দেখার-কারণে সীমিত পরিচয় (ক্রিস্টোফার হিল্টনের লেখা “Ayrton Senna: The Whole Story” বইটা পড়ে) একটু ঝালিয়ে নিলাম।
ক্রিকেটীয় রচনাগুলো খুঁটিয়ে পড়তে অনেকটা সময় গেছে – বিশেষত ESPN Cric Info, HowSTAT, Wikipedia থেকে তথ্য যাচাই করতে, কারণ আমার স্মৃতি মাঝেমাঝেই প্রতারণা করে – কোনও কোনও তথ্য / বাক্য / বিবৃতি পড়তে খটকা লাগে আর তখনই ইন্টারনেট থেকে (মাঝে মাঝে বই থেকেও বটে) তা যাচাই করি – সাহেবরা যাকে ‘nitpicking’ বলে আর বাঙালিরা বলে ‘খুঁতখুঁতেমি’। কিন্তু “ভাল জিনিসে ভুল থাকবে যথাসম্ভব কম”, এই প্রাচীনপন্থী মানসিকতা থেকে বেরোতে পারিনা।
সীমিত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাংলা cricketing non-fiction-এর পাঠক হিসেবে, শঙ্করীপ্রসাদ বসু এবং (আংশিকভাবে) অজয় বসু ও রাখাল ভট্টাচার্য এঁদের ইন্টারনেট-পূর্ববর্তী যুগের প্রভাব আমাকে ছাড়েনা। অতএব কিছু কিছু তথ্যবিচ্যুতি / তথ্যবিভ্রান্তি আমার নজরে এসেছে, সেগুলো ব্যক্তিগতভাবে লেখককে জানিয়েছি; উদ্দেশ্য একটাই – পরের সংস্করণে যেন সেগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়, কারণ এই বইয়ের পাঠ-প্রচার-প্রসার প্রবল প্রয়োজনীয়, বাংলাভাষায় ক্রীড়াসাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করবার জন্য।
সবশেষে বলি বইয়ের কাগজ-ছাপাই-অলঙ্করণ ইত্যাদি ভাল, hard-bound বাঁধাইটার দিকে আরেকটু নজর দেওয়া বোধহয় প্রয়োজন, কারণ এ বই একাধিকবার উল্টেপাল্টে পড়তে ইচ্ছে হওয়াই স্বাভাবিক। দুশোর বেশি পৃষ্ঠার বইটিতে মুদ্রণ-প্রমাদ ও বানান-ভুল সংখ্যায় বেশ কম। অর্থাৎ সম্পাদনা ও প্রুফ-রিডিংয়ের কাজে যত্নের ছাপ আছে যার জন্য প্রকাশক ও মুদ্রক ধন্যবাদ পাবেন।