“অভির স্বপ্ন” [জানুয়ারি-২০২০ সংস্করণ] বই আকারে পড়লাম – মন্দ লাগেনি। বিষয়টা বেশ নতুন ধরণের – খেলার মাঠে ‘লাইফ-থ্রেটনিং’ চোট পাওয়া, সেরে ওঠা ও মাঠে প্রত্যাবর্তন – এই নিয়ে বাংলা ক্রীড়া-সাহিত্যে বিশেষ কেউ লিখেছেন বলে আমি অন্ততঃ জানিনা [অবশ্য আমার জানার পরিধি খুবই সীমিত]।
মনে পড়ছে মতি নন্দীর “অপরাজিত আনন্দ” শেষ হয়েছিলো হৃদযন্ত্রের জন্মগত দুর্বলতায় আক্রান্ত প্রতিশ্রুতিবান কিশোর পেস-বোলিং অল-রাউন্ডার আনন্দর খেলোয়াড়ি জীবনে অকালসমাপ্তি নেমে আসার প্রবল সম্ভাবনার অনিশ্চয়তার মধ্যে।
এখানে কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-মঞ্চে ঢোকার লড়াইয়ে লেগে থাকা তরুণ খেলোয়াড় অভিনন্দন ভট্ট প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে ঘরোয়া ক্রিকেটে মূল্যবান ইনিংস খেলে রান করে আবার বিদেশ সফরে ভারতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছে, এই পরিস্থিতিতে লেখা শেষ হচ্ছে। এটা উৎসাহের একটা বড় জায়গা। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে অনীশের আগামী কোনও লেখায় হয়ত অভিকে আবার আমরা দেখতে পাবো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আঙিনায় ব্যাট হাতে দেশের হয়ে লড়ে যেতে!
লেখকের গদ্যটা বেশ ঝরঝরে তরতরে সহজপাঠ্য। অতএব পড়তে বিশেষ হোঁচট খেতে হয়নি। তবে অভির রিকভারি ও রিহ্যাব অংশটা আমার একটু বেশিই রিপোর্টাজ-ধর্মী লেগেছে। যদিও জানতে পেরেছি স্পোর্টস মেডিসিন / অর্থোপেডিক্স / নিউরোলজি নিয়ে কিছু তথ্য [ডঃ কল্যাণ মুখার্জীর কথাও মনে হয়েছে মাঝে-সাঝে – এই বিষয়ে আমার মোল্লার দৌড় ঐ মস্জিদ পর্যন্তই!], কিন্তু কেমন যেন একটু একমাত্রিক লেগেছে। একটু বোঝাবার চেষ্টা করি।
অভির আরোগ্য ও প্রত্যাবর্তন নিয়ে অভির নিজের, এবং পাশাপাশি ছন্দক, নীপা ও নীলমাধবের, উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তা-নৈরাশ্য আরেকটু প্রকাশ পেলে বোধহয় বেশি লাগসই মনে হ’ত। সত্যি বলছি, আমার এই রিহ্যাব পর্বটা একটু বেশি সহজ-সরল মনে হয়েছে – জ্বালা-যন্ত্রণা-বিরক্তি-রাগ একটু যেন কম – মানে প্রসূন-কমল-কোনি-ক্ষিদ্দা এদের তুলনায় আর কি [সেই কবে (‘মতি’চুরের) ঘি খেয়েছি – বুড়োদের এই স্বভাব!] – হয়ত কিশোর পাঠকদের কথা ভেবেই লেখক এই পন্থা নিয়েছেন।
আরেকটা কথা সন্তর্পণে বলি – চরিত্রগুলো প্রায় সবাই বড্ড ভাল মানুষ, বড় সোজাসুজি। দুয়েকজনের মধ্যে খানিকটা ধূসরতার প্রলেপ থাকা হয়ত দরকার ছিল। যদি দেবরাজের এত সাহায্য করার পেছনে নিজস্ব কোনো স্বার্থসিদ্ধি বা কোনো কর্মকর্তার ওপর পুরোন কোনও ঝাল মেটানোর আকাঙ্খা থাকত, “তবে কেমন হ’ত তুমি বলো তো”। খেলার দুনিয়াটা (বাকি দুনিয়াটাও) তো এমনই, তাই না!
নীলমাধবের খেলার জগতের পুরোন পরিচিতদের এতখানি এড়িয়ে চলার রহস্যটা কিন্তু বুঝলাম না। তবে সেটা নিছকই আমার (বদ)স্বভাবগত ‘tying up all the loose ends’ ধাতের খুঁতখুঁতুনি, এতে গল্পের কোনো ইতরবিশেষ হয়নি।
শেষে বলি – বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ও বৈচিত্র্য বোধহয় লেখকের মজ্জাগত, কলমে (নাঃ, কী-বোর্ডে) রয়েছে সহজপাঠ্য ভাষা, আর রয়েছে প্লট সাজাবার গৃহিণীপনা – সুতরাং অনীশ খোলামনে নিজের খেলাটা খেলে যান, রান আসতে থাকুক।
বই আকারে নতুন বেরোচ্ছে যদিও পূজো-২০২১ মহালয়ার দিন সন্ধ্যায় “পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা” খুলে সূচীপত্র দেখে প্রথমেই “স্কোরকার্ডের নেপথ্যে” চলে গিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম।
ভালই লেগেছে – ‘ট্যুইন-ট্র্যাক’ প্লটটা লেখক বেশ ভাল ফেঁদেছেন। ঝরঝরে তরতরে সহজপাঠ্য গদ্য (সহজপাচ্যও বটে)। তবে শুরু থেকে বেশ অনেকখানি পর্যন্ত ফর্মে-থাকা সুনীল গাভাস্করের ধাঁচে ক্রমান্বয়ে ইনিংস তৈরি করে তারপর কিন্তু শেষের দিকে কেমন যেন চতুর্থ / পঞ্চম গিয়ারে ফর্মে-থাকা ইউসুফ পাঠান ধরণে সব ডেলিভারিতেই ‘বিগ হিট’ মারবার প্রচেষ্টার ছাপ।
বন্দনার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারেই শুভ্রর সব মুশকিল-আসান, “রাজস্থানে রহস্যভেদ” (জটায়ু জিন্দাবাদ!) – এটা খানিকটা টি২০-র অষ্টাদশ / ঊনবিংশ ওভারে ১৮-২০ রান তোলবার মত লেগেছে আমার। তবে এটাই হয়ত এখন ‘কুল ক্লাইমাাক্স’ বলে অধিকাংশ কিশোর পাঠক-পাঠিকা মনে করেন।
মতি নন্দীর সৃষ্ট অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড়ি নায়ক-নায়িকাই [কোনি বা “তার শেষ ইনিংস”-এর তুহিন লাহিড়ী বা “জীবন অনন্ত”-র অনন্ত সেন ছাড়া] তাদের ওস্তাদের মার-টা কলকাতার বাইরে দেয়নি। কোনি, তুহিন, অনন্ত দিয়েছে দেশেরই অন্য শহরে। অঞ্জ ত্রিপাঠী দিয়েছে ‘ওল্ড ব্লাইটি’-র খানদানী কেনিংটন ওভাল (এখনকার কিয়া ওভাল) মাঠে। এটা খুব সম্ভবতঃ বিশ্বায়ন এবং দেশের-বাইরে-জয় – এই দুইয়ের মিলিত আকাঙ্খারই প্রতিফলন।
শেষে বলি – ‘চিরাচরিত’ প্রথায় মহিলা-মনের ইতিহাস না ঘেঁটে মহিলা-ক্রিকেটের বুনোহাঁসের পেছনে ধাওয়া করবার লেখকের এই সাহস দেখে মতি নন্দীর মহিলা-উইকেট-রক্ষক কলাবতী (ওরফে কালু) নিশ্চয়ই বলত, “বো-ও-ও-ঔ-লিং, অ-নী-ঈ-ঈ-শ!”