যত দোষ নাকি ‘অরুণলাল’ ঘোষ!

গল্পটা প্রায় পুরাতন প্রস্তর যুগের!

২০০০ সালের ১ মে। পি সেন ট্রফির ফাইনাল। মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল। সে-মরসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে শেষ ট্রফি এবং ইস্টবেঙ্গল একটিও ট্রফি জেতেনি। প্রায় কুড়ি বছরের কলকাতা ক্লাব ক্রিকেটে এমন ঘটেনি কখনও অরুণ লালের।

ছবি লেখকের সংগ্রহ থেকে

মোহনবাগান আগে ব্যাট করে তুলেছিল ২৬৯। তারিখটা আর একবার মনে করুন, পয়লা মে। ইডেনে দুপুরে মাঠে দাঁড়ানোই কঠিন। ভরদুপুরে প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির ওপরেই দাপট দেখানো শুরু তারপর। ১৯৫৫ সালে যাঁর জন্ম ২০০০ সালে তিনি প্রায় ৪৫। উৎপল চট্টোপাধ্যায়, দেবাং গান্ধী, দীপ দাশগুপ্ত, লক্ষ্মীরতন শুক্লা, নিখিল হলদিপুররাও সে-মাঠেই। ইডেনে ঘরোয়া দলের সাজঘরের বারান্দায় অশোক মালহোত্রার সঙ্গে আমরা দু-তিনজন, অন্তত ছায়ায়। বাইরে প্রখর তাপে চাঁদি ফেটে যাওয়ার জোগাড়।

দেখা গেল সে-অরুণের তেজও ম্লান এ-অরুণের কাছে! পঁয়তাল্লিশের বুড়োকে হারানো যাচ্ছে না। মালহোত্রা ক্রমশ অধৈর্য। কুড়ি-তিরিশ-চল্লিশ পেরিয়ে যাচ্ছেন অরুণ। বাংলা ক্রিকেটে তখন অরুণ-অশোক মানে দুই শিবিরই। সেই অশোকের ক্রমাগত নির্দেশ, ‘উসকো আউট করো, জলদি’।

হল না, পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দিকে। অশোক আমাদের বলছিলেন হিন্দিতেই, বাংলা তর্জমায়, ‘সত্তর পেরত দাও, নাটক শুরু হবে। গ্লাভস খুলবে, জুতোর ফিতে বাঁধবে, প্যাড খুলে ফেলবে, দৌড়ে ক্রিজে ঢুকে পড়ে যাবে — দেখতে থাকো।’

বিশ্বাস করা কঠিন হলেও, ঘটনা বলে এবং গল্পে বিন্দুমাত্র কল্পনার নুন না মেশানো থাকায়, পরিষ্কার মনে আছে, ঠিক ঠিক ওই-ওই কাজগুলোই আমরা করতে দেখছিলাম অরুণকে। সেঞ্চুরির কাছাকাছি যখন, ‘নেহি হোগা, লে গ্যয়া ম্যাচ’ বলে অশোক দ্রুত মাঠ ছাড়লেন। অরুণ মাঠ ছাড়লেন তার অনেকক্ষণ পর। নামের পাশে অপরাজিত ১৪৪, ইস্টবেঙ্গলের ঘরে একমাত্র ট্রফি সেবারের। শিবির উল্টো হলেও অশোক ঠিক কতখানি চিনতেন অরুণকে — বোধহয় এগুলোই হাড়ে হাড়ে চেনা! — ভেবে আমরাও অবাক।

ব্যক্তিগত সংগ্রহ : কাশীনাথ ভট্টাচার্য

কেন এই গল্পটা হৃদয়-খুঁড়ে জাগিয়ে-তোলা?

কারণ, এই অরুণ লাল, যিনি ছেষট্টি এবং ক্যান্সারকেও পরাভূত করে এসেছেন ছ’বছর আগে, বাংলার কোচের দায়িত্বে এখন এবং এবারের রনজি ট্রফিতে প্রথম ম্যাচে বরোদার বিরুদ্ধে বরাবাটি স্টেডিয়ামে প্রথম ইনিংসে ৮৮ অলআউট, সিএবি-র অন্দরমহলে ফিসফিসানি জোরদার, ‘বুড়োটাকে তাড়াতে হবে’! আদ্যিকালের বদ্যি আর চলে না। মিলিটারি শাসন এই প্রজন্মের কাছে অর্থহীন। এই প্লেয়াররা অন্যভাবে বড় হয়েছে, অত পুরনো দিনের কথায় আর তাদের নতুন করে অনুপ্রাণিত করা সম্ভব নয়, ‘ফলানা-ডিমকা’, ভারতীয় ক্রিকেট সার্কিটে থাকলে শেষ দুটো শব্দ আপনি শিখে যাবেন অবশ্যই!

দেখা গেল, বাংলা সেই ম্যাচ চতুর্থ ইনিংসে সাড়ে তিনশো তাড়া করে জিতল। পরের ম্যাচেও সরাসরি জয় হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে। এলিট বি গ্রুপের শীর্ষে ১২ পয়েন্ট নিয়ে। শেষ ম্যাচ চন্ডিগড়ের বিরুদ্ধে, যাদের ঘরে মাত্র এক পয়েন্ট। পরের পর্বে পৌঁছনো নিশ্চিত প্রায়। সেই অরুণের কোচিং বা ম্যানেজারিতেই।

মুশকিল এই তাড়াহুড়ো নিয়ে। একটা ম্যাচেও নয়, একটা ইনিংসেই গেল-গেল। এবং, কোচ তাড়াও! রান পাচ্ছে না ব্যাটাররা। তবু যত দোষ ‘অরুণলাল’ ঘোষ!

বাংলা দুটো ম্যাচ জিতেছে, বোলাররা দারুণ করেছেন, কিন্তু ব্যাটাররা? একটাও শতরান? ইনিংস টেনে নিয়ে যাওয়া, যা রনজিতে সাফল্যের এক ও একমাত্র শর্ত? পুরনো দিন হলে অরুণ হাতের আঙুল মটকে বলতেন, ‘গিনাও, কিতনে শও কিয়ে’।

কতটা সমীহ করেন বাংলার ক্রিকেটাররা? রনজি ফাইনালের শেষ দিন সকালে তাঁর খেলা বল বোলার উনাদকাটের হাতে যাওয়া সত্ত্বেও আকাশদীপ বোকার মতো ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ক্রিজে ফেরার চেষ্টাই করেননি। উনাদকাটের থ্রো সরাসরি উইকেট ভাঙে, বাংলার আশা শেষ। আকাশ নিজেকে আউট ‘আবিষ্কার’ করে ফিরে এসে চড়া রোদে গ্যালারিতে বসেছিলেন, সাজঘরে কোচের মুখোমুখি হতে না-চেয়ে। এটাই ভয়, এটা জরুরি। জবাবদিহির ভয়, এমন একজনের সামনে দাঁড়ানোর ভয় যিনি সর্বার্থেই অকুতোভয়।

বাংলা ক্রিকেটের কর্তারা যেন কোচ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অন্তত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটীয় ধৈর্য দেখান, প্লিজ!