ভারতীয় ক্রিকেটের গত শতাব্দীর সাত-আট দশকের “শর্মাজী কা বেটা”

সব শুরুরই একটা শুরু থাকে।


আজ ৩৯ বছর পরেও ১৯৮৩র বিশ্বকাপ জয়কে কেউ বলেন “ফ্লুকে জয়”,কেউ বলেন “টিমএফর্টের জয়” আবার কেউ বা বলেন “অলরাউন্ড পারফর্মেন্সের জয়”। কিন্তু ২৫ জুন ১৯৮৩র বিশ্বকাপ জয়ের মাস তিনেক আগে, ২৯ মার্চ ১৯৮৩তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বিসে “আমরাও পারি”র বিশ্বাসের প্রদীপে প্রথম সলতে পাকিয়েছিল ভারতীয় দল (৪৭ ওভারে ২৮২/৫), ওডিআই সিরিজের ২য় ম্যাচে, ২৭ রানে প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (৪৭ ওভারে ২৫৫/৯), হারিয়ে দিয়ে।সেই ম্যাচে ২৬ বলে ৩টি ঝকঝকে চারসহ ২৩ রান করা ছাড়াও রবি শাস্ত্রীর বলে ফাউদ বাক্কাসের ক্যাচ নিয়েছিলেন এক গাঁট্টাগোট্টা ভারতীয় ক্রিকেটার। ১৯৮২-৮৩র সেই ৩ ম্যাচের ওডিআই সিরিজ ১-২ ফলে হেরেছিল ভারত আর ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ হেরেছিল ০-২ ফলে। ৫ টেস্টে ৯ ইনিংস খেলে ২টি অর্ধশতকসহ ২২২ রান আর ৩ ওডিআই ম্যাচ খেলে ৫৩ রান করেছিলেন সেই ভারতীয় ক্রিকেটার। এইরকমই “চোখ না টানা” পারফরমেন্স করেও “টিমম্যান” হয়ে সে সময় টিমের জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিতেন যশপাল শর্মা।তবু চিরকালীন আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি জীবনভর থেকে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে।

অতঃপর ৯-২৫ জুন, ১৯৮৩র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের প্রখর গ্রীষ্মকালকে নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারের বসন্তদিনে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিলেন সেই তিনি, যশপাল শর্মা। ৯ জুন ১৯৮৩, বিশ্বকাপের প্রথম গ্রুপ ম্যাচেই ওল্ড ট্রাফোর্ডে ভারত হারাল তখন দুরন্ত, তখনো আয়োজিত ২টি বিশ্বকাপই জেতা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে, আড়াই মাসের মধ্যে ২য় বার।তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওডিআই-তে হারানোর চেয়ে অসম্ভব খুব কম জিনিসই ছিল বিশ্ব ক্রিকেটে। সেই ওল্ড ট্রাফোর্ডের ম্যাচে ৮৯ রান (৯X৪) করে ভারতকে জয়ের রাস্তা দেখিয়েছিলেন তিনি, যশপাল শর্মাই।আর একটি গ্রুপ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০ জুন চেমসফোর্ডে তাঁর ৪০ রান আজও চর্চার বিষয়, ভারতীয় ক্রিকেটে।কিন্তু আজও সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় ওল্ড ট্রাফোর্ডের সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২২ জুন তারিখে তাঁর করা ৬১ রান (৩X৪, ২X৬) নিয়ে, সন্দীপ পাতিল ও মহিন্দার অমরনাথকে সঙ্গে নিয়ে ৫০:৫০ ম্যাচ যিনি অনায়াসে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের জিম্মায়। তিন দিন পরের লর্ডস ফাইনালে অবশ্য মাত্র ১১ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন তিনি। ৮ ম্যাচে ২৪০ রান করেছিলেন তিনি সেই বিশ্বকাপে, ৩৪.২৮ গড়ে। নিজের ১০০ শতাংশ দিয়ে দেওয়া খেলা দিয়েই তিনি অমর থেকে গেছেন ভারতের ক্রিকেটে, বিশেষত প্রথম বিশ্বকাপ জেতায়। তবু, তবুও গোটা জীবন ভারতীয় ক্রিকেটে চিরকালীন আন্ডাররেটেড হয়েই থেকে গেছেন যশপাল শর্মা।

২ আগস্ট ১৯৭৯ থেকে ২৯ অক্টোবর ১৯৮৩র মধ্যে ৩৭টি টেস্ট খেলে ২টি শতরান ও ৯টি অর্ধশতরান এবং সর্বোচ্চ ১৪০ রান (বনাম ইংল্যান্ড, চেন্নাইতে) সহ ৩৩.৪৫ গড়ে ১৬০৬ রান করেছিলেন যশপাল শর্মা।আর ১৩ অক্টোবর ১৯৭৮ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৯৮৫র মধ্যে ৪২টি ওডিআই খেলেছিলেন তিনি, রান করেছিলেন ৮৮৩, ২৮.৪৩ গড়ে, যার মধ্যে ছিল ৪টি অর্ধশতরান আর সর্বোচ্চ ছিল ভারতের জেতা ১৯৮৩র বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে করা ৮৯।টেস্ট আর ওডিআই, দুই ধরণের ক্রিকেটেই ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং তাকে এনে দিয়েছিল ১টি করে উইকেটও।সামগ্রিক হিসেবে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পরিসংখ্যানেও চিরকালীন আন্ডাররেটেড হয়েই কাটিয়ে গেছেন ক্রিকেটার যশপাল শর্মা।

দেখনদারি না, কার্যকরী ক্রিকেটেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি, যশপাল শর্মা। ১৯৭৯র বিশ্বকাপে ভারতীয় স্কোয়াডে থাকা তিনি একটি বলের জন্যও মাঠে নামেন নি। ১৯৮১-৮২তে চেন্নাইতে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ (২২২) আর তিনি (১৪০) জুটিতে ৩১৬ রান করার পথে একটা গোটা দিন ব্যাট করে অপরাজিত থেকে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, যার স্মৃতিচারণ করেছিলেন বিশ্বনাথ। তবে তাঁর আসল মাস্তানি ছিল দু’দশক জুড়ে বিস্তৃত ১ম শ্রেণীর ক্রিকেটে, ১৬০ ম্যাচে ৮৯৩৩ রান (২১ শতরান, ৪৬ অর্ধশতরান) সাক্ষ্য দেয় একথার স্বপক্ষে। তবু চিরকালীন আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতের ক্রিকেটে।


টেকনিকালি খুব সাউন্ড ছিলেন তিনি, কেউ কখনো বলবেনা, কিন্তু দলের জন্য তাঁর পরিশ্রম আর চেষ্টা ছিল সশব্দ। তিনি খেলা ছাড়ার পরে ধারাবিবরণী ও আম্পায়ারিং করেছিলেন যোগ্যতার সাথে। ২ দফার নির্বাচক ছিলেন তিনি, ২০০৪-২০০৫ আর ২০০৮-২০১১য়। চ্যাপেল অধ্যায়ে খোলাখুলি অধিনায়ক সৌরভের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যশপাল শর্মা, উচিত কথা সোজাসাপটা বলে দিতে যার কোন জুড়ি ছিলনা। তবুও ভারতীয় ক্রিকেটে আন্ডাররেটেড হয়েই সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের গত শতাব্দীর সাত-আট দশকের “শর্মাজী কা বেটা”।

১৩ জুলাই ২০২১ তারিখের সকালে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার দিন থেকে গুগল সার্চে ফিরে এসে আজও সেখানের পিচে অপরাজিত থাকা ক্রিকেটার যশপাল শর্মার জন্ম হয়েছিল লুধিয়ানায় ১৯৫৪র ১১ আগস্ট তারিখে। তার আগে তাঁর নাম টাইপ করলে গুগলে দেখা যেত তাঁর সমনামী এক অভিনেতার ডিটেলস। ক্রিকেটের মত জীবনেও চিরকালীন আন্ডাররেটেড হয়েই কাটিয়ে গেছেন ক্রিকেটার যশপাল শর্মা।

১৯৮৩র সেই বিশ্বজয়ী টিমের প্রথম কেউ মৃত্যুর আউটসুইংয়ে “আউট” হয়ে গিয়েছিলেন, বছরখানেক হল। ভারতীয় ক্রিকেটের এক ঐতিহ্য ও আদরের মণিমুক্তোর সেট থেকে তাঁর ১৯৮৩র টিমমেটদের বেদনাবিধুর স্মৃতিচারণের কান্নাভেজা পোষাক পরে ১৩ জুলাই ২০২১ তারিখে ঝরে গিয়েছিল এক অমূল্য মুক্তো, চেষ্টা করে যাওয়াই ছিল যার জীবনের মূলমন্ত্র, ব্যাটিং-বোলিং আর ফিল্ডিংয়েও। সহখেলোয়াড় ও ক্রিকেটপ্রেমীদের চূড়ান্ত রায়ে কিন্তু সসম্মানেই প্রপার রেটিং পেয়ে উৎরে গিয়েছিলেন যশপাল শর্মা।

আচমকাই কোন নোটিস না দিয়েই ঝরে যাওয়া, ডাগ আউটে দুধপানের জন্য বিখ্যাত যশপাল শর্মা ৬৮ পেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল আজ। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই তাঁকে। যেখানে আছেন, ভালো থাকুন যশপাল শর্মা।