সুনীল রঙের চুয়াত্তর

(১)
আমি সানি-কে নিয়ে কিছু লেখা মানেই অনেক অসূয়ার জ্বালামুখ খুলে যাওয়া, অনেকের বুকে ব্যথা, অনেকের দুরারোগ্য সানিটাইটিস-এর লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া। তবু সানির ৭৪-এ পা দাবী করে “উইলোর উইল”-এ এই লেখাটা। পৃথিবীর সমস্ত “সানি ঘৃণা” ছুটিতে যাক মিনিট কয়েকের জন্য।

১৯৭১-এ ছিল “সানি ডেজ”, সঙ্গতে ছিলেন দিলীপ সরদেশাই। ৪ টেস্টে সানির ৭৭৪ তাঁকে নিয়ে ক্যালিপসো লিখিয়ে গাইয়ে নিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের শিল্পীদের দিয়ে। যে কোন হাফ-প্যান্ট পরা বালককে আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করার জন্য তা ছিল যথেষ্ট। তাই গ্রাসে চলে গিয়েছিলাম সানির। তারপর ৫১ বছর পেরিয়ে এলাম, সে গ্রাস থেকে আর বেরোতে পারিনি। আগামী কয়েক বছরেও অথবা আমৃত্যু পারবনা হয়ত। আবাহনে-বিসর্জনে, ব্যাটে-বলে, দুঃখ-সুখে, তাঁর সাথেই থেকে যেতে হবে আজীবনকাল। সানি কোন সুযোগই দিলেন না তাঁর গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার। এতদিনেও। সানির হয়ে আমার কথা বলার, হাত চালানোর (পরে কলম ধরার আর মাউস চালানর) বয়েসও তো ৫১ হল। আর ভালো লাগেনা। “আমারও তো বয়েস হচ্ছে, রাতবিরেতে কাশি…” তবু, আজ আবার।

(২)
ভাস্কর গাঙ্গুলীকে গান গাইতে বললে তিনি শুনতেন “গা ভাসকার”। ৫০এর দশকে জন্মানো বালকেরা তখন ওই একটা পদবীই জানত। গাভাসকার।

১৯৭৪-এর ইংল্যান্ড সফরে সুধীর নায়েক এবং “মার্ক ও স্পেনসার” এপিসোড। কেউ তাঁর রুমমেট হতেও রাজি নন। সানি এগিয়ে এলেন তাঁর রুমমেট হতে। তারপর থেকে আজ অবধি ৪৮ বছরে একদিনের জন্যও “মার্ক ও স্পেনসার” থেকে কেনাকাটা করেননি সানি।

(৩)
১৯৭৮-এর ডিসেম্বর। ভারত সফরে আসা আপাতদুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (কেরি প্যাকার এফেক্ট) প্রায় একাই গিলে খাচ্ছেন সুনীল গাভাসকার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বাঙ্ক করে ক্যান্টিনে রিলে শুনতাম আমি আর আমার নেমসেক সহপাঠী। সুনীল গাভাসকারের একটা ডাবল-সেঞ্চুরী হল একদিন ঐ সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে, মুম্বাইতে। ২য় ইনিংসে তিনি করলেন ৭৩। গুরুগম্ভীর আলোচনার পরে আমরা একমত হয়েছিলাম যে লোকটা মানুষ না, ভগবান। পরিষ্কার মনে আছে, আজও।

১৯৭৯-র জুলাই। সাত মাস বয়স তখন ব্যাঙ্কের চাকরি নিয়ে রাণীগঞ্জে মেসে থাকার। সঙ্গে একটা ছোট টেপ-কাম-রেডিও। সেই রেডিওটা ১৯৭৯-র রোমহর্ষক কলকাতা ফুটবল লীগের ধারাবিবরণী শুনতে চমৎকার কাজে দিত। সেই রেডিওতেই ১৯৭৯-র জুলাইতে শুনেছিলাম ‘গুরু’র অবিশ্বাস্য ২২১, ওভালে।একটুর জন্য ড্র হয়েছিল ম্যাচটা।’গুরু’ আর একটু টিঁকে থাকলে, হয়ত ড্রটা হতনা।

(৪)
১৯৮৩-র জুলাই মাসে “ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার”-এর সম্পাদক সানি (যিনি ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের হয়ে ওপেন করে ২ রান করেছিলেন) একটি প্রকাশিতব্য বাংলা বইয়ের জন্য একটি অণু-ভূমিকা লিখে দেন। যা শেষ হয়েছিল এইভাবে – “এই বিশ্বজয়ে দলের সবার ভূমিকা ছিল। আমারও। আমার করা ২ রান না হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে টার্গেট ১৮৩-র বদলে ১৮১ থাকত এবং তারা আর একটু কম চাপে থাকত।” বইটি অবশ্য শেষ অবধি বেরোয়নি নানা কারণে। কিন্তু ভূমিকাময় “গল্প”টা রয়ে গেছে। সানির “কৌতুকবোধ” ক্রিকেটকে তখন আরও রঙীন করে রাখত।

১৯৮৩-রই ২৯শে অক্টোবর। ৪ মাস আগে ভারতের কাছে বিশ্বকাপ হারানো দোর্দন্ডপ্রতাপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলোধোনা করে ইনিংসে হারিয়েছে ভারতকে, কয়েকদিন আগে কানপুরে ১ম টেস্টে। মার্শাল (এখন প্রয়াত) একাই চালিয়েছেন ধ্বংসযজ্ঞ, ২ ইনিংসেই আউট করেছেন সানিকে, একবার হাত থেকে ব্যাট ফেলে দেওয়া সমেত। আগের দিন ২৮শে প্রাক্টিসে দিল্লীর সুসভ্য বোদ্ধা দর্শকরা বলে দিয়েছেন “সানি, তেরে পিছে মার্শাল আ রহা হ্যায়।” সব অপমানের জবাব দিল একটি ব্যাট ২৯শে। ২৯ শতরানের ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড (সেই সময় এভারেস্ট মানা হত) স্পর্শ করলেন সানি সেদিন। এবং সেদিন রবার্টস আর হোল্ডিংয়ের চেয়েও ওনার হাতে অনেক বেশী “মার” খেয়েছিলেন যে বোলার, তার নাম মার্শাল।

“নো ম্যাতা, নো ম্যাতা, নো ম্যাতা, হোয়াত নাম্বার ইউ ব্যাত, দ্য স্কোর ইজ স্টিল জিরো।” ইনিংস স্কোর ০-২, এই অবস্থায় ৪ নম্বরে ব্যাট করতে নামা সানি-কে বলেছিলেন ভিভ। শীতের দুপুরের হালকা মিঠে রোদের মত ছিল তখনকার স্লেজিং। স্থান – এম. এ. চিদাম্বরম স্টেডিয়াম, চিপক, মাদ্রাজ। কাল – ২৭শে ডিসেম্বর, ১৯৮৩। ওই ভারত বনাম ওয়েস্টইন্ডিজ ৬ষ্ঠ টেস্টেই সানি করেছিলেন তার ৩০তম শতরান, অপরাজিত ২৩৬, যা ছিল তাঁর সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোর।

এবারে চলুন ১৯৮৫-র ২২শে মার্চ তারিখে। শারজা-তে ভারত বনাম পাকিস্তান, রথম্যানস কাপের প্রথম গ্রুপ ম্যাচে। তার ঠিক আগে অস্ট্রেলিয়াতে বেনসন হেজেস কাপ জিতে এসেছে ভারত ১২ দিন আগে আর পাকিস্তানও তখন ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট টিম। মাত্র ১২৫ রানে ইনিংস শেষ করেও ৩৮ রানে ঐ ম্যাচ জিতে নেয় ভারত। ইমরান খানের ১০-২-১৪-৬-এর পরে আর কারো “ম্যাচপুরুষ” হওয়ার কথা উঠতেই পারে না বলে মনে করা হলেও শোনা যায় যে গাভাসকারের নাম নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার পরেই ইমরান খানের নাম এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়। ২টি অসাধারণ ক্যাচ সহ মোট ৪টি ক্যাচ নিয়ে সেদিন নিজেকে এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন সুনীল গাভাসকার।

অনেককেই (বহু বিদগ্ধজন সমেত) বলতে শুনি, সানি গাভাসকার আবার “তেমন বোলিং” খেললেন কবে? সম্পূর্ণ একমত আমি তাদের সাথে।আসলে তিনি ঠিকঠাক ব্যাট করলে কোন বোলিংকেই আর “তেমন বোলিং” মনে হতনা।১৯৮৫-৮৬-র অ্যাওয়ে সিরিজে সিডনিতে ১৭২ রান আর ১৯৮৭-র লর্ডসে বাইসেন্টিনারি টেস্টে ১৮৮ রান করার পথে ওইরকমই “ঠিকঠাক ব্যাটিং” করেছিলেন সানি।

(৫)
১৯৮৭-র মার্চ। ব্যাঙ্গালোর (তখনো বেঙ্গালুরু হয়নি) টেস্ট। বনাম পাকিস্তান। তখনও সুনীল গাভাসকার নামে একজন ওপেনার ছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর খেলা শেষ টেস্ট। ঘূর্ণি পিচে সেই ম্যাচটা তিনিও বাঁচাতে পারেননি। কিন্তু ইজ্জতটা বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর অলৌকিক ৩২০ মিনিটে ৯৬ দিয়ে। ৯৬-এ আউট হয়ে জীবনের শেষ টেস্ট বেঙ্গালুরুতে (তখনো ব্যাঙ্গালোর) হেরে মনমরা হয়ে বসে সানি। ৩০ মিনিট পরে ক্যাপ্টেন কপিল ধরে নিয়ে যান পাক ড্রেসিংরুমে, অভিনন্দন জানাতে। যেতেই মিয়াঁদাদ বলেন “সরি সানিভাই।” সানি বলেন “কেন?” জাভেদ – “সিলিপয়েন্ট থেকে গালাগালি দেবার জন্য।” সানি – “আমি তো শুনিনি কিছু।” জাভেদ – “সিলিপয়েন্ট থেকে দেড়ঘন্টা টানা স্লেজ করলাম, শোননি?” সানি – “এক একটা দিন অন্য একটা স্তরে চলে যাই ব্যাট হাতে। ব্যাটিং ছাড়া আর কিছু মাথায় থাকে না। সিরিয়াসলি কিছু শুনিনি আজ। তোমার মুখ নাড়ানো দেখেছি মাঝে মাঝে। ভেবেছিলাম ফিল্ডারদের কিছু বলছিলে।” জাভেদ – “তাহলে সরি বললাম কেন?” (১৬ জুন ২০১৯য়ের “সংবাদ প্রতিদিন” থেকে।) এগুলোই আসলে দাদাগিরি, যা তখন করা হত মাঠে নেমে, কথায় নয়। এখন ক্রিকেটে ব্যক্তিরা আছেন, অভাব চরিত্রর।এখন ক্রিকেটে দাদারা আছেন, নেই দাদাগিরি।

তাঁর কোন সেঞ্চুরীতে কটি বাউন্ডারি, মনে রাখতে রাখতে কেটে গিয়েছিল কৈশোর-যৌবন। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির ভদ্রলোক আকাশ-সমান উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটকে ১৯৭১-১৯৮৭, এই ১৬ বছরে। তারই ফাঁকে টেস্টে ১০,০০০ রানও এসে যায় তাঁর ব্যাটে। তারপর কত ১০,০০০+ দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। “আপাতত প্রথম” ১০,০০০+ কিন্তু লেখা আছে তাঁর নামেই। আজও।

সেই ১৯৭১-এর ৪ টেস্টে ৭৭৪ থেকে শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলা তাঁর ইনিংসগুলির মধ্যে অনেকগুলিই ওখানে রূপকথা নামে পরিচিত। আজও তাঁর নামে লোকগাথা গাওয়া হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজে।টেস্ট ক্রিকেটের সাবেকিয়ানাকে আধুনিকতায় পৌঁছে দেবার কারিগরদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়ে গেছেন তিনি আজও। আজকের “ফ্যানসঙ্কুল” ক্রিকেট-সময়ে আজও এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ার মত বয়ে যান তিনি।

(৬)
আর তাঁর ক্রিকেট কমেন্ট্রি? একটি উদাহরণ তো এখনো যেন কানের সামনেই আছে, যেটা শুনেছিলাম গত ৮ই মার্চ, ২০১৯ তারিখে। ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া। তৃতীয় একদিনের ম্যাচ। রাঁচিতে। নিশ্চিত হারের দিকে এগোচ্ছে ভারত। বিজয়শঙ্করের বিরুদ্ধে অযথা আউটের আবেদন করলেন আদম জাম্পা, লেগস্টাম্পের অনেক বাইরে পায়ে বল লাগা সত্ত্বেও। ভারতীয় ইনিংসের ৪২তম ওভারে। ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন ছবির এই ভদ্রলোক। আর যে জন্য আজও তাঁর ধারাবিবরণীর চাতক হয়ে থাকি, সেটা ঘটল আচমকাই, তখনই। তিনি বললেন – “This reminds me of my school day’s cricket and the umpire thereof Mr. Parkar. Whenever there was such type of meaningless appeal by the bowler, he used to reject the appeal with his immaculate question ‘For what? Please explain.’ As a result of the same, the bowler did not have the courage to repeat such type of imaginative appeal any more.”

এই সূক্ষ্ম হিউমার, এই জীবনবোধওয়ালা ধারাভাষ্য ক্রমশ অপসৃয়মান, আজকের ক্রিকেট থেকে।আজকের এই শুষ্ক, রুক্ষ, পানপরাগী ক্রিকেটদুনিয়ায় ছবির এই ভদ্রলোক আজও তার ভাষ্য-জাদু নিয়ে হাজির থাকেন গ্রীষ্মকালের মেঘলা দুপুরের মতই।

অধিনায়ক সুনীল গাভাসকারকে চেনেন না? তাঁকে চেনার জন্য তাঁর অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৮৫-র বেনসন-হেজেস টুর্ণামেন্টে করা তাঁর অধিনায়কত্বের “গল্প হলেও সত্যি” জেনে নেওয়াই যথেষ্ট, যা এখনো লোকমুখে ঘোরে। সেই ক্যাপ্টেন্সি আসলে জিতিয়ে দিয়েছিল ক্রিকেটকে। সেই ক্যাপ্টেন্সি লোকগাথা হয়েছিল ভবিষ্যতের জন্য। সেই ক্যাপ্টেন্সি জানিয়ে দিয়েছিল, মাঠে গিয়ে যারা শুধু খেলাই দেখেন, তাঁরা ক্রিকেটের কিছুই দেখেননা। আর ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল সুনীল গাভাসকারের এই ক্যাপ্টেন্সি।

(৭)
১২৫টি টেস্টের ২১৪ ইনিংসে ১৬ বার অপরাজিত থেকে তাঁর অর্জন ছিল ৫১.১২ গড়ে ১০,১২২ রান, ৪টি দ্বিশতরান সহ ৩৪টি শতরান ও ৪৫টি অর্ধশতরান সহ। ২৬টি ওভারবাউন্ডারি আর ১,০১৬টি বাউন্ডারিতে সাজানো ছিল সানির টেস্ট কেরিয়ার। টেস্টে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে চেন্নাইতে ১৯৮৩-৮৪ সিরিজের ৬ষ্ঠ টেস্টে করা ৪২৫ বলে অপরাজিত ২৩৬ (২৩X৪)। টেস্টে তিনি ক্যাচ নিয়েছিলেন ১০৮টি।

আর ১০৮টি ওডিআই-র ১০২ ইনিংসে ১৪ বার অপরাজিত থেকে তিনি করেছিলেন ৩৫.১৪ গড়ে ৩,০৯২ রান, ১টি শতরান ও ২৭টি অর্ধশতরান সহ। সানির ওডিআই কেরিয়ার সাজানো ছিল ২১টি ওভার-বাউন্ডারি আর ২৩৪টি বাউন্ডারি দিয়ে। ওডিআই-তে তাঁর সর্বোচ্চ রান ছিল নিউজিল্যান্ডর বিরুদ্ধে নাগপুরে ১৯৮৭-র বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে করা ৮৮ বলে অপরাজিত ১০৩ (৬x৩, ৪x১০)। ওডিআই-তে তাঁর নেওয়া ক্যাচের সংখ্যা ছিল ২২টি।

বিশ্ব ক্রিকেটে মূল্য না চুকিয়ে বা বিনামূল্যে যে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের উইকেট পাওয়া যেতনা বা যায়না, তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন সানি গাভাসকার।

ভারতীয় ক্রিকেটারদের লেখার মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বহুলপঠিত সুনীল গাভাসকারের লেখা।অসংখ্য বইয়ের লেখক তিনি। এর প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি পাতাতেই সানির নির্মোহ ক্রিকেট-প্রজ্ঞা এবং অনাবিল হিউমার ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে আছে। পাঠকরা সানিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন এই বইগুলি দিয়ে। ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার পাওয়া সানি গাভাসকার ১৯৯৪ সালে মুম্বাইয়ের শেরিফ হয়েছিলেন। অ্যালান বর্ডার এবং সানি গাভাসকারের যুগ্ম নামে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার বিজয়ী দলকে দেওয়া হয় বর্ডার-গাভাসকার ট্রফি (দু’জনেই ১০,০০০য়ের উপর টেস্ট রানের অধিকারী এবং যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের অধিনায়ক ছিলেন)। তাঁর আদি হোমটাউন ভেঙ্গুর্লা-তে তার নামে তৈরী হয়েছে গাভাসকার স্টেডিয়াম। ২০০৩ সালে তৃতীয় “MCC Spirit of Cricket Cowdrey স্মারক বক্তৃতা” দেওয়া তিনিই ছিলেন প্রথম ও শেষ ভারতীয় ক্রিকেটার। ২১ নভেম্বর ২০১২ সালে বিসিসিআই সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের হাত থেকে তিনি পেয়েছেন বোর্ডের ২০০১-১২র কর্ণেল সি কে নাইডু লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার।

(৮)
১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ মুম্বাইয়ে ১২টি ধারাবাহিক শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছিল। নিহত হয়েছিলেন ২৫৭ জন নিরীহ মানুষ। গোটা মুম্বাই জুড়ে শুরু হয়েছিল ভয়াবহ দাঙ্গা। সেদিন নিজের জীবন বিপন্ন করে তাঁদের কমপ্লেক্সের সামনের রাস্তায় ছুরি, তরবারি হাতে উন্মত্ত মারমুখী জনতার চক্রব্যূহের ভেতরে থাকা একটি গাড়ির মধ্যে বসে থাকা এক দম্পতি ও তাদের শিশুপুত্রকে বাঁচিয়েছিলেন প্রায় একা সানি।

সেই ঘটনার অনেক পরে ২০১৬ সালে দুনিয়া প্রথম জেনেছিল ঘটনাটির কথা। সানি না, সেই ১৯৯৩য়ের ১২ মার্চের ঘটনার অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী মুম্বাইয়ের স্পোর্টস জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের গোল্ডেন জুবিলি অনুষ্ঠানে, ঘটনাটি শ্রোতাদের সামনে বলেছিলেন। সেই প্রত্যক্ষদর্শীর নাম রোহন গাভাসকার, যিনি সেদিন কমপ্লেক্স-এর বারান্দা থেকে পুরো ঘটনাটি দেখেছিলেন।ঘটনাটি বিশদে “দ্য উইক” পত্রিকায় লিখেছিলেন জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার যজুবেন্দ্র সিং।

পরে ক্রিকেটারদের অধিকার নিয়ে অনেক লড়াই করেছেন সানি, তৈরী করেছেন প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন। দুঃস্থ অবসর-নেওয়া ক্রিকেটারদের পেনসনের ব্যবস্থা করেছেন সানি। বেনিফিট ম্যাচ খেলে টাকা তুলে দিয়েছেন তিনি, করেছেন মুম্বইয়ের প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটারদের ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা।

কিন্তু সম্ভবত তাঁর সেরা অবদানটি ছিল নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিনটি প্রাণ বাঁচিয়ে দেওয়া। যা ঘটনার ২৩ বছর পরেও কাউকে জানতে দেননি সানি গাভাসকার।

(৯)
নিজের টার্মে থাকা, কাউকে তৈলমর্দন না করা, এইসব কারণই তাঁকে অনন্য করেছে আর অব্যবহৃত থেকে গেছেন অবসরোত্তর তিনি, ভারতীয় ক্রিকেটে। তবু আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্বে ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটন এখনো তাঁরই হাতে। তাঁর ক্রিকেটবোধের অটোগ্রাফেই এখনো উজ্জ্বল ভারতীয় ক্রিকেটের আন্তর্জাতিকতা।

আমি চাই আমার জীবনের শেষ দিন অবধি এই সানি-আচ্ছন্নতা আমাকে আগলে রাখুক। সানিকে খেলতে দেখে ফেলার পরে এক জীবন আর কি চাইতে পারে?

আজ থেকে ৭৩ বছর আগে “জীবনের ব্যাটে খড়ি” হয়েছিল লিটল মাস্টারের। ভালো থাকুন। ক্রিকেটে থাকুন।

শুভ ৭৪তম জন্মদিন, অবসরের দিন “এখনও কেন?”-কে “এখনই কেন?”-তে পাল্টে দেবার পথপ্রদর্শক সুনীল মনোহর গাভাসকার।