কোন টেস্টম্যাচ খেলেননি তিনি কোনদিন। ৫৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৯.৫৯ গড়ে তাঁর রান ২,৫৩৪। ছ’টি শতরান আর ১১টি অর্ধশতরান, সর্বোচ্চ ১৫৮। তবু অনেকেই নাকি বলেন তাঁর বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার ভাইয়ের চেয়েও ভাল ব্যাটসম্যান ছিলেন এই ভদ্রলোক। অনেকের আবার মত এই যে সর্বকালের সেরা বাংলা দলেও এসে যাবেন এই ক্রিকেটারটি।
বেহালার নিখাদ ক্রিকেট পরিবারের ছেলে তিনি, যাঁর বাবা ছিলেন দীর্ঘদিন ময়দানে ক্রিকেট খেলা প্রাক্তন সিএবি সচিব চন্ডী গাঙ্গুলী। ছোট থেকেই ক্রিকেটকে ভালবাসতে তাই অসুবিধে হয়নি তাঁর। বড়িষা ক্লাবের আঁতুড়ঘর টপকে পূর্বাঞ্চল অনুর্দ্ধ-১৫ দলের হয়ে বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে তাঁর অভিষেক হয়েছিল ১৯৭৯-৮০ সালে। আশ্চর্য হলেও সত্যি এটাই যে, বাংলা অনুর্দ্ধ -১৫ দলের হয়ে তাঁর অভিষেক হয় পরের মরশুমে অর্থাৎ ১৯৮০-৮১তে। পরের বছর তিনি বাংলা স্কুল দলের হয়েও খেলেন। তারপরে তিনি খেলেছেন বাংলা অনুর্দ্ধ-১৯ ও বাংলা অনুর্দ্ধ-২২ দলের হয়ে। খেলেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে রোহিংটন বারিয়া ট্রফিতে আর ভিজি ট্রফিতে পূর্বাঞ্চল বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়েও।
তারপরে তাঁর জন্য খুলে যায় বড় আসরের দরজা। রণজি ট্রফিতে তাঁর অভিষেক হয়েছিল বিহারের বিরুদ্ধে ১৯৮৬-৮৭ সালে। অভিষেকেই করেছিলেন আশ্বাস দেওয়া ৫৭ রান। পরের বছর ১৯৮৭-৮৮তে আসামের বিরুদ্ধে তিনি করেছিলেন তাঁর প্রথম শতরান (১০৭)। আবার আসামের বিরুদ্ধে শতরান করেন তিনি পরের মরশুমে, ১৯৮৮-৮৯তে। ১৯৮৮-৮৯তে সেমিফাইনালে প্রথম ইনিংসে তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে করেন ৮১ রান। ফাইনালে বাংলা হেরে যায় দিল্লির কাছে, দিল্লিতে। সেই ম্যাচে ব্যর্থ হন তিনি, করেন ৭ রান।
কলকাতার ইডেনে দিল্লিকেই ফাইনালে হারিয়ে রণজি ট্রফি জেতে বাংলা পরের বছর ১৯৮৯-৯০ সালে। ফাইনালে তিনি বাদ যান এবং তাঁর বদলি হয়ে রণজি অভিষেক হয় সৌরভ গাঙ্গুলীর। দল নির্বাচনের পরদিন আনন্দবাজারে গৌতম ভট্টাচার্যের রিপোর্টের হেডিং ছিল “রাজের বদলে মহারাজ।” তবে রঞ্জি জয়ী বাংলার স্কোয়াডে তিনি ছিলেন, এটা ইতিহাসে রয়ে গেছে।
কিন্তু রণজিতে তাঁর সেরা ইনিংস ছিল পরের মরশুমে (১৯৯০-৯১) কোয়ার্টার-ফাইনালে কর্ণাটকের বিরুদ্ধে ইডেনে। ৩.১৭ কোশেন্টে ২৪৯ ওভারে কর্ণাটক প্রথম ইনিংসে করে ৬ উইকেটে ৭৯১ (অর্জুন রাজার ২৬৭, রাহুল দ্রাবিড়ের ১৩৪, সৈয়দ কিরমানির ১১২ আর জসবন্তের ১১৯ সমৃদ্ধ)।হ্যাঁ, ঠিক পড়ছেন ৭৯১। ৩৩১/৫ এইঅবস্থায় ব্যাট করতে এসে শ্রীনাথ, প্রসাদ, কুম্বলে ও প্রাক্তন টেস্ট খেলোয়াড় রঘুরাম ভাট সমৃদ্ধ কর্ণাটক বোলিংয়ের বিরুদ্ধে পায়ের শিরায় টান, অসহ্য ব্যথা, ঠিকভাবে দাঁড়ানো যাচ্ছেনা, এই অবস্থায় রানার প্রণব রায়কে নিয়ে সাড়ে ছয় ঘন্টা ব্যাট করে ২৯৫ বলে (১১×৪) অপরাজিত ১১৬ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংস খেলেন তিনি। এক এক করে উল্টোদিকে আউট হয়ে যেতে দেখেন দ্বিশতরানকারী শ্রীকান্ত কল্যাণী (২৬০), শরদিন্দু মুখার্জী (৬), উৎপল চ্যাটার্জী (৬) আর দত্তাত্রেয় মুখার্জীকে (৫)। ৫৭৫ রানে ৯ উইকেট পড়ার পরে (প্রথম ইনিংস শেষ হলে রানে জিতে যেত কর্ণাটক, শেষ না হলে কোশেন্টে অর্থাৎ রান/ওভারের হিসেবে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হবার কথা ছিল) উল্টো দিকে ক্রিজে আসেন পেসার ও শেষ ব্যাটসম্যান সাগরময় সেনশর্মা (বছরদুয়েক আগে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় খবরের শিরোনামে এসেছিলেন), যাঁর প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ব্যাটে গড় ছিল ৯.৭৩। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পায়ের জন্য প্রায় খেলার অনুপযুক্ত এই ভদ্রলোকের শেষ উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ৭৭ রান (যার মধ্যে সাগরময়ের রান ছিল অপরাজিত ১০) বাংলাকে কোশেন্টে এগিয়ে দেয়। ২০০ ওভারে ৯ উইকেটে ৬৫২ রান করা বাংলার কোশেন্ট দাঁড়ায় ৩.২৬। কোশেন্টে এই ম্যাচ জিতে সেমি-ফাইনালে চলে যায় বাংলা। খেলার পরে শ্রীনাথ, প্রসাদ, কুম্বলে মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছিলেন তাঁর ঐ অসাধ্যসাধন-করা ইনিংসের। বাংলার শেষ উইকেট ফেলতে কর্ণাটকের যাবতীয় চেষ্টা সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর ব্যাটে ধাক্কা খেয়ে। আমার দেখা বাংলার হয়ে সেরা রণজি ইনিংস ছিল ওটাই। ঐ ইনিংসটি খেলা না হলে শ্রীকান্ত কল্যাণীর (২৬০) ইনিংসটিও মাঠে মারা যেত।ঐ অমানুষিক অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংসটি মাঠে বসে দেখেছিলাম বলে আজও গর্ব হয়।
১৯৯৩/৯৪-রঞ্জি কোয়ার্টার-ফাইনালে হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে ১৯টি চার ও ১টি ছয় মেরে তার ১৪৯-এর কথাও বাংলার ক্রিকেট-রসিকেরা কোনদিন ভুলতে পারবেন না। ২৬১ রানে অল আউট হয়ে যাওয়ার পরে হায়দ্রাবাদ বাংলার অরুণলাল, আই বি রায়, শ্রীকান্ত কল্যাণী ও সৌরভ গাঙ্গুলীকে আউট করে দেয় খুব তাড়াতাড়ি। উইকেট নেন সৈয়দ মিরাজ (২), এন পি সিং (১) ও কানোয়ালজিত সিং (১)। সেই সময় ক্রিজে নামেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই আউট হন অশোক মালহোত্রাও (১০৯/৫)। মোট আট ঘণ্টা ব্যাট করে, প্রথমে চেতন শর্মা (৬২) ও তারপরে মিন্টু দাশকে (২৬) সঙ্গে নিয়ে, বাংলাকে (৩৯২) হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে জয়ের রাস্তা দেখান এই ব্যাটসম্যান।
দুর্বোধ্য কারণেই তাঁর সামনে খোলেনি টেস্টের দরজা। যে কারণে খেলা থেকে অবসরও নিয়ে নেন তড়িঘড়ি করেই, ১৯৯৭তে। ২০২০ থেকে সিএবি-র সচিবের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিনি। তাঁর স্ত্রী হলেন বিখ্যাত মোহিনীআট্টম নৃত্যশিল্পী মোম গাঙ্গুলী, তাঁদের একমাত্র কন্যার নাম স্নেহা।
আজ ১১ই জুন তাঁর জন্মদিন – তিনি স্নেহাশিস গাঙ্গুলী, যাঁকে রাজ নামে চিনত বাংলার ক্রিকেট-সমাজ।
শুভ জন্মদিন, স্নেহাশিস “রাজ” গাঙ্গুলী।