জন্মদিনের ক্যালেন্ডার – একাদশ পর্ব

মরশুম ২০০৫-০৬। শুরু হল ফয়সালাবাদের মাটিতে পাক-ভারত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১,৭৮২)। গ্রেগ চ্যাপেল কাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় অল্পকাল আগেই অধিনায়কত্ব খোয়ানো সৌরভ গাঙ্গুলীর সটান দল থেকেই বাদ পড়ায় তুমুল বিতর্ক বাধে দেশ জুড়ে। কেউ খেয়াল করেনি উত্তরপ্রদেশীয় ন্যাটা পেসার রুদ্রপ্রতাপ সিং-এর ইন্ডিয়া ক্যাপ পাওয়ার দৌলতে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বন্ধ্যাত্বের দুর্নাম ঘুচল ডিসেম্বরের ষষ্ঠ তারিখটির। এমন তো হামেশাই ঘটে। এখনও ফাঁকা পড়ে থাকা একশো তেষট্টিটি তারিখের কোনও কোনওটির বেলাতেই হয়তো যা ঘটবে অদূর ভবিষ্যতেই। ঘটনা হল, লর্ডসের উদ্বোধনী টেস্ট থেকে ধরলে দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি লেগেছিল যে দিনটির নিষ্ফলতা ঘুচতে, পরবর্তী দেড় দশকেই দেশীয় ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের পাতায় সেই তারিখটিই রচনা করে বসে আছে এক অনন্যসাধারণ নজির। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২০২১-২২ কানপুর টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২,৪৩৫) পূর্বোক্ত তিনশো তিনের অন্তিম প্রতিনিধি হিসেবে মুম্বইকর মিডল-অর্ডার শ্রেয়স আইয়ারের ইন্ডিয়া ক্যাপ প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই ৬ ডিসেম্বরে ভূমিষ্ঠ পঞ্চম টেস্ট ক্রিকেটারকে পেয়ে গিয়েছে দেশ। এক যাত্রায় এতজনের এক তারিখে পৃথিবীর আলো দেখার নজির ক্যালেন্ডারের পাতায় আর দ্বিতীয়টি নেই।

ডিসেম্বর ৬, ১৯৮৫। রায়বরেলিতে জন্ম রুদ্রপ্রতাপের। ২০১১ অবধি মোট চোদ্দোবার সাদা পোশাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন দেশের। পক্ষান্তরে এই নিবন্ধটি রচনার মুহূর্ত অবধি চারবার জাতীয় দলের জার্সিতে টেস্ট ক্রিকেটের আসরে অবতীর্ণ শ্রেয়সের জন্ম ১৯৯৪-এর এই বিশেষ তারিখে মুম্বইতে। মধ্যবর্তী পর্বে আর কে কে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন রুদ্রপ্রতাপের লেগাসিকে? যথাক্রমে এঁরা হলেন, টেস্ট ক্রিকেটের ময়দানে আজ অবধি অন্তিম ভারতীয় ‘ডাবল’-ধারী রবীন্দ্র জাডেজা (জন্ম ১৯৮৮, নাভাগম-খেদে), ২০১৬-১৭ মরশুমে খেলা ৬ টেস্টেই দেশীয় ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ন হয়ে নজির গড়া কর্ণাটকি মিডল-অর্ডার ব্যাটার করুণ নায়ার (জন্ম ১৯৯১, যোধপুরে) এবং ২০১৭-১৮ থেকে শুরু করে এখনও অবধি ২৯ টেস্ট খেলা গুজরাটি ফাস্ট বোলার যশপ্রীত ‘বুম বুম’ বুমরা (জন্ম ১৯৯৩, আমদাবাদে)।

১৮ অক্টোবর ও ২৪ নভেম্বরের সঙ্গে ৬ ডিসেম্বরকে জুড়ে মনেই হতে পারে ক্রিকেট দেবতা যেন বছরের শেষ দিকটায় বেশি করে মনোযোগী হয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটকে দাক্ষিণ্য প্রদর্শনে। ঘটনা হল বছরের এই শেষ তিন মাসে জন্মানো ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটারদের সংখ্যাগুলি যথাক্রমে ৪২, ২১ ও ৩৭। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক ১০০। সেই হিসেবে আজ অবধি সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করা পুরুষদের এক তৃতীয়াংশই ভূমিষ্ঠ হয়েছেন এই তিন মাসে। খতিয়ান ঘাঁটলে উপরন্তু দেখা যায় বছরের আর কোনও মাসেই জন্ম হয়নি অক্টোবরের মতো এত ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটারের। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর অবধি ফি মাসের সংশ্লিষ্ট সংখ্যাগুলি যথাক্রমে ২৪, ২০, ২৭, ২২, ১৪, ১৮, ২১, ২৭ ও ৩০। দেখা যাচ্ছে মে মাসে জন্ম হয়েছে সব চাইতে কম জনের।

শীতপ্রধান বিলেতের গ্রীষ্মকালীন সংস্কৃতির অঙ্গ ক্রিকেট একদা এদেশে চিহ্নিত ছিল শীতকালীন খেলা হিসেবেই। অক্টোবর থেকে মার্চ (অর্থাৎ ক্রস-ইয়ার মরশুম) অবধি চলত ক্রিকেট ঋতু। মরশুমি ফুলে রঙিন হয়ে থাকত বাগান। আর কলকাতায় খেলা পড়ত সফররত বিদেশি দলগুলির। দেখা যাচ্ছে বছরের এই সময়টায় জন্মানো ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটারদের মোট সংখ্যাটাও (১৭১) তৎকালীন অফ সিজনে ভূমিষ্ঠদের (১৩২) তুলনায় কিছু বেশি।

ক্রিকেট-রসিক পাঠকের অবশ্যই অজানা নয় যে ষোড়শ ভারতীয় পুরুষ হিসেবে আবির্ভাবেই টেস্ট শতরান করেছেন শ্রেয়স। লালা অমরনাথের সূত্রে জিমখানায় সূচনা যে ইতিহাসের পরবর্তী অষ্টাশি বছরে কারা কারা এগিয়ে এনেছেন তার উত্তরাধিকার? তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় নাম দু’টিও ইতিমধ্যে হয়েই গিয়েছে আমাদের জানা। যথাক্রমে দীপক শোধন ও কৃপাল সিং।

দেখে নেওয়া যাক বাকিদের।

চতুর্থ নামটি হায়দরাবাদি টপ-অর্ডার আব্বাস আলি বেগের (জন্ম মার্চ ১৯, ১৯৩৯-এ হায়দরাবাদে)। ১৯৫৯ ম্যাঞ্চেস্টার টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৪৭৭) শতরানকারী বেগ ১৯৬৬-৬৭ অবধি বিস্তৃত কেরিয়ারে খেলেছিলেন ১০ টেস্ট। প্রসঙ্গত, ১৯০৭-এর এই তারিখে অবিভক্ত পাঞ্জাবের লাহোরে জন্ম তিনের দশকে ৩ টেস্ট খেলতে পারা উইকেটরক্ষক দিলওয়ার হুসেনের।

পঞ্চম নামটি ইতিমধ্যে এসেছে আমাদের আলোচনায়। মানুষটি হলেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯৬৩-৬৪ দিল্লি টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৫৫৬) শতরানকারী রাজস্থানি মিডল-অর্ডার হনুমন্ত সিং।

ষষ্ঠ নামটি ১৯৮২-৮৩ অবধি সময়পর্বে ৯১ টেস্ট খেলা কর্ণাটকি মিডল-অর্ডার গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের (জন্ম ফেব্রুয়ারি ১২, ১৯৪৯-এ ভদ্রাবতীতে)। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৬৯-৭০ কানপুর টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬৬৬) শতরানকারী এই উইলো শিল্পীই প্রথম চুরমার করেন অভিষেকে শতরান করা ভারতীয় পুরুষদের আর কখনও টেস্ট শতরান না পাওয়ার সেই অদ্ভুত নজিরটি। শোনা যায় কানপুরে যখন শতরানের দোরগোড়ায় বিশ্বনাথ, রেডিয়োয় কান রাখা তাঁর বন্ধুবান্ধবেরা চাইছিলেন যেন তিন অঙ্কে পৌঁছনোর আগেই সাজঘরে ফিরতে হয় তাঁকে। প্রসঙ্গত, ১৯৮৪-র এই তারিখে দাবানাগেরেতে জন্ম অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০১১-১২ পার্থ টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২,০২৯) খেলা কর্ণাটকি পেসার বিনয় কুমারেরও।