‘বায়োমেকানিক্স’: ক্রিকেটে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ – তৃতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্বে বোলিংয়ের ডেলিভারি (delivery) ও ব্যাটিংয়ের প্রাথমিক সম্মুখবর্তী / পশ্চাদবর্তী চলনে (initial forward / backward movement) বায়োমেকানিক্স ব্যাপারটার প্রয়োগ কি সেটা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। এই পর্বে ব্যাটিংয়ের গ্রিপ (grip) / স্ট্যান্স (stance) ও বোলিংয়ের সাইড-অন / চেস্ট-ওপেন অ্যাকশনের (side-on / chest-open action) ওপর এর কিছু প্রভাব সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা যাক।

[ছবি: ইন্টারনেট]

ব্যাটিং

ব্যাট ধরবার গ্রিপ বা ব্যাট ধরে দাঁড়াবার স্ট্যান্স কেমনভাবে একজন ব্যাটারের পারফরমেন্স-এর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে? কয়েকটা উদাহরণ নিয়ে দেখা যাক। 

আসিফ ইকবাল [পরিচয় নিষ্প্রয়োজন] ব্যাট ধরবার সময় তাঁর একটা হাত হাতলের (handle) আগায় রাখতেন, অন্য হাতটা রাখতেন হাতলের গোড়ায়। এতে তাঁর খেলবার ধরণে প্রভাব পড়ত কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এটা তাঁর পক্ষে ভালই কাজ দিত। পিটার উইলি [পরবর্তীকালের আন্তর্জাতিক আম্পায়ার – সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে এক দশক ধরে ইংল্যান্ড দলের হয়ে পঞ্চাশটারও বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন।] বোলারের সম্মুখীন হতেন চেস্ট-অন (chest-on) অবস্থায় আর তারপর শট খেলবার আগে ঘুরে যেতেন সাইড-অন (side-on) অবস্থায়!

‘ত্রুটিযুক্ত’ গ্রিপ কিছু কিছু স্ট্রোক খেলতে অসুবিধে তৈরি করতে পারে, কিন্তু কোনও ব্যাটার যদি তাঁর গ্রিপ নিয়ে স্বস্তিবোধ করেন এবং রান পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর বদলাবার বিশেষ কোনও কারণ নেই। আসলে কোচিং নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে একটা অপপ্রচার চলে – কিছু লোক মনে করেন এটা একজন তরুণ ক্রিকেটারকে একটা ছাঁচে ফেলে দেওয়ার পন্থা – সবাইকে (ইংল্যান্ডের পঞ্চাশের দশকের অল-রাউন্ডার) ট্রেভর বেইলির মতন ধরণে খেলতে শেখানো – তাতে কাজ হয়না। 

ছোটরা পারিপার্শ্বিক প্রভাবে পড়ে এবং তারা যেকোন রকম মাঠে খেলে বেড়ে ওঠে, তাদের নিজেদের মতন করে শট খেলতে শেখে। ক্রিকেট তো শুধুমাত্র কৌশলের ব্যাপার নয়, এটা ব্যক্তিগত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশও বটে। একজন প্রকৃত কোচকে বায়োমেকানিক্স বিজ্ঞান এবং খেলোয়াড়ের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এক ‘সঠিক সমন্বয়’ তৈরিতে সাহায্য করতে জানতে হবে – তবেই ‘সেরা ফল’-টা পাওয়া যাবে।

বিখ্যাত মারকুটে, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও সনথ জয়াসূরিয়ার মতন ব্যাটাররা ত্যারচা (angled) ব্যাটে, বল ওঠার মুখে (on the rise) শট খেলে বিধ্বংসী ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁদের এইধরণের ব্যাটিংয়ের পেছনেও কি বায়োমেকানিক্সের নীতিই কাজ করেছে?

হতেই পারে, কিন্তু আগেই বলেছি যে কোচিং মানেই সবাইকে ক্রিকেট-শিক্ষার পাঠ্যবই অনুযায়ী খেলতে শেখানো নয়। গিলক্রিস্ট ব্যাট গ্রিপ করেন হাতলের একদম ওপরের কাছে আর এইজন্য এত জোরে শট খেলতে পারেন। আর হ্যাঁ, তাঁর কয়েকটা উদ্ভাবনী স্ট্রোকও আছে। তবে এমন উদ্ভাবন তো আর নতুন কিছু নয়। কয়েকটা উদাহরণ দিই।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে দু’পায়ের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে শট মারা হয়েছে শোনা যায়। ফ্রেড স্পফোর্থ তাঁর ‘হাফ-বল’ (half-ball) উদ্ভাবন করেন, যেটা অনেক ধীরগতির ডেলিভারি, যা তিনি তাঁর আঙ্গুলে আলগা করে বলের অর্ধেকটা ধরে করতেন [বর্তমানের পেসারদের ‘স্লোয়ার’ মনে পড়ছে তো!]। বসাঙ্কোয়েট নাকি অক্সফোর্ড বিশববিদ্যালয়ের বিলিয়ার্ড টেবিলের ওপরে বল ঘোরাতে গিয়ে উদ্ভাবন করেন ‘গুগলি’ [যাকে আজকাল আমরা অনেকেই ‘রং-ওয়ান’ বলে থাকি!]। জ্যাক আইভার্সন মধ্যমা ভাঁজ করে বল স্পিন করিয়েছেন [‘ক্যারম-বল’ ভুলে গেলেন!]। এসব কিন্তু তাঁদের সেই সময়কার কোন ক্রিকেট-শিক্ষার পাঠ্যবইতে ছিলনা, তবে অবশ্যই এইসব উদ্ভাবন ক্রিকেটকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

যেকোন খেলার মূল সারমর্ম হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা, যাকে বায়োমেকানিক্স আর ক্রিকেট-শিক্ষার পাঠ্যবই দিয়ে কোনভাবেই চেপে রাখা উচিৎ নয়। 

বোলিং

বোলারদের বোলিং অ্যাকশন দুই আলাদা ভঙ্গির হয় – সাইড-অন এবং চেস্ট-ওপেন। এর মধে একটা কি অপরটার থেকে বেশি কার্যকরী? 

তার কোনও মানে নেই। প্রথমে ধরা যাক কিছুটা ‘কম-প্রচলিত’ চেস্ট-ওপেন অ্যাকশনের কথা। মাইক প্রোক্টর পুরোপুরি এই ভঙ্গিমায় বল করতেন এবং বেশ ভাল জোরেই করতেন। বায়োমেকানিক্সের কথায়, তিনি প্রথম শর্ত – বলের সমষ্টিকরণ (summation of forces – দ্বিতীয় পর্ব দেখুন) – মানতেন। যেখান থেকে তিনি বল ডেলিভারি করবেন ক্রিজের সেই জায়গাটার দিকে তিনি সরাসরি দৌড়ে যেতেন, এবং লক্ষ্যের প্রতি তাঁর পুরো ভরবেগ (momentum) তিনি বজায় রাখতেন। তাঁর সামনের পা প্রথম স্লিপের দিকে থাকত কিন্তু পাশের দিকে কোনও মোচড় না থাকার ফলে তাঁর শরীরে অনাবশ্যক ধকল পড়তনা। কিন্তু সাইড-অন বোলাররা যেমন তাঁদের রান-আপ থেকে প্রয়োজনীয় বলের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মতন পেয়ে থাকেন, প্রোক্টর হয়ত সেখানে পেতেন ৩০ শতাংশ। সাইড-অন বোলার যেমন কাঁধ ও বাহু থেকে প্রয়োজনীয় বলের ৪০ শতাংশ পান, প্রোক্টর হয়ত সেখানে পেতেন ৩০ শতাংশ। 

চেস্ট-ওপেন বোলাররা বলকে (তুলনায়) বেশি ভেতরে ঢুকিয়ে আনতে (inward movement) পারেন, তাঁদের পিঠের নিচের অংশে অনেক কম ধকল পড়ে – কারণ মোচড় খুবই কম – আর লেগ-কাটার (leg-cutter) দেওয়ার সুবিধেও বেশি।  

সাইড-অন বোলাররা তাঁদের শরীরের ঊর্ধাংশটা বেশি কাজে লাগাতে সুবিধে পান। বলকে (তুলনায়) বেশি বাইরে নিয়ে যেতে (outward movement) পারেন, বলের ওপর খানিকটা ড্র্যাগ (drag) দিতে পারেন, কিন্তু চেস্ট-ওপেন বোলারদের মতন বলকে অতটা ভেতরে ঢুকিয়ে আনতে পারবেন না।

দুই পদ্ধতিরই সুবিধে-সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু বিপদ হতে পারে যদি এই দু’ধরণের ভঙ্গি মিশে যায় – যখন বোলরের শরীরের ঊর্ধাংশটা সাইড-অন থাকতে চেষ্টা করে আর নিতম্বের অংশটা ছড়ানো (hips open) থাকে। 

আচ্ছা, জেফ টমসন তো নাকি এমন সাইড-অন ছিলেন যে তাঁকে অনুকরণ করা নাকি প্রায় অসম্ভব! একটা কথা সোজাসুজি জানিয়ে রাখি – টমসন ছিলেন প্রকৃতির এক খামখেয়াল। উনি এতটাই সাইড-অন ছিলেন যে ওঁর গোড়ালির পেছন দিকটা প্রায় উইকেট বরাবর থাকত। উনি বলটা ডেলিভারি করতেন বর্শা ছোঁড়বার মতন করে আর ওঁর ভঙ্গিমার প্রায় পুরোটাই ছিল কাঁধের খেলা। ওঁর রান-আপ থেকে ওঁর গতির প্রায় কিছুই আসতনা কারণ উনি পা ধীরে ধীরে টেনে (shuffle) বোলিং করতে আসতেন। যেকোন চেস্ট-ওপেন বোলারের থেকে তিনি তাঁর শরীর থেকে অনেক বেশি বল ব্যবহার করতেন। ওঁর অ্যাকশন যদি আরো প্রচলিত ভঙ্গির হ’ত উনি কি তাহলে চোট-আঘাত বেশি এড়াতে পারতেন? কে বলতে পারে? 

আপনাকে এটা বুঝতে হবে যে ক্রিকেটে বোলিংটা একটা অতি-অস্বাভাবিক কাজ। অন্য কোন খেলায় আপনি দেখেছেন যে কেউ তার শরীরটাকে পাশের দিকে নড়িয়ে (moving body sideways) কিছু একটা ছুঁড়তে চেষ্টা করছে – হয়ত বর্শা-ছোঁড়া (javelin throwing)? আপনি যেদিকে বল করতে চান তার সমকোণে লাফ দিয়ে ওঠেন যেটা অস্বাভাবিক এবং এমন পরিস্থিতিতে চোট-আঘাত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। চেস্ট-ওপেন বা সাইড-অন, পেস বোলিং মোটেই স্বাভাবিক কর্ম নয় – এটা সর্বদা খেয়াল রাখবেন, অনুগ্রহ করে।

আজকের পর্বটা একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শেষ করি। ফ্রেডি ট্রুম্যান [টেস্টে প্রথম ৩০০ উইকেট সংগ্রহকারী বোলার – জানেন নিশ্চয়ই!] এক কোচের মুখে শোনেন যে ক্রিকেট নাকি এক side-on game – শুনে ফ্রেডি উইকেট-রক্ষকের প্যাড-গ্লাভস পরে উইকেটের পেছনে গিয়ে সাইড-অন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন!

[পুনশ্চ: ফ্র্যাঙ্ক টাইসনের কিছু রচনা ও সাক্ষাৎকারের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।]