‘বায়োমেকানিক্স’: ক্রিকেটে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ – দ্বিতীয় পর্ব

আগের পর্বে দুটো ছোট ঘটনার উল্লেখ করে আর সঙ্গে কয়েকটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বায়োমেকানিক্স জিনিসটা কি সেটা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। এই পর্বে বোলিং ও ব্যাটিংয়ের সঙ্গে এর সম্পর্কটা কেমন সেটা আরেকটু বিশদে দেখাবার চেষ্টা করি।

ছবি : গুগল

[ছবি: ইন্টারনেট]

বোলিং

যদি আপনি জোরে বল করতে চান, শরীরটাকে যেতে হবে বলের সমষ্টির (summation of forces) মধ্যে দিয়ে। যে গতিতে আপনি বল করেন তাতে শরীরের প্রতিটা অংশের কিছু-না-কিছু অবদান থাকে। লিলির বলের গতির জন্য প্রয়োজনীয় বলের ১৬-১৭ শতাংশ নাকি আসত তাঁর রান-আপ থেকে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া পরিমাপ অনুযায়ী এর সঙ্গে থাকত তাঁর পা, ধড়, কাঁধ ও বাহুর প্রভাব – ৪০ শতাংশ আসত কাঁধ ও বাহুর থেকে, ৩০ শতাংশ আসত পা ও শরীরের নিচের অংশ থেকে, আর বাদ বাকিটা আসত কব্জি-সহ অন্যান্য অংশ থেকে।

আপনি যখন আপনার শরীরের এই বলগুলোকে যোগ করেন, সর্বপ্রথমে আপনি ব্যাটারের দিকে দৌড়োন – তারপর আপনি গতি কমান বা থামেন, আর বলটা আপনার পায়ে সঞ্চারিত হয় – তারপর তা সঞ্চারিত হয় আপনার ধড়ে – সেখান থেকে আপনার কাঁধে ও বাহুতে। শরীরের এই প্রতিটা অংশই, যে গতিতে বলটা ডেলিভারি করা হয়, পরপর বলসঞ্চার করতে কাজ করে। যতক্ষণে আঙ্গুলগুলোর প্রান্ত থেকে বলটা ছাড়া হয় – সম্ভবত বেশ দ্রুতগতিতে – এই সব বলগুলো যোগ হয়ে যায়। সত্যিই জোরে বল করবার সঠিক কায়দা হচ্ছে যে একটা নির্দিষ্ট রৈখিক দিকে বলগুলোর এই সমষ্টিকরণ যাতে হয়, এটা নিশ্চিত করা।

এর থেকে বিচ্যুতি হলেই বলের গতিবেগ কমে। আপনি যদি মোটামুটি সোজাসুজি না দৌড়ে এঁকেবেঁকে দৌড়োন, তাহলে রান-আপের ঐ (মোটামুটি) ১৫ শতাংশ থেকে সরে যাবেন। বল করবার সময় আপনার পা যদি পাশের দিকে চ্যাটালো হয়ে প্রসারিত হয় – ব্যাটারের দিকে না হয়ে স্লিপের ফিল্ডারের দিকে – বলের গতিবেগ কমে যাবে। আপনার বাহু যদি পাশের দিকে হেলে যায়, তাহলেও একই অসুবিধে।

কৌশলগত ঘাটতি কিন্তু চোট-আঘাতের সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেয়। আপনার শরীরের ঊর্ধাংশ যদি একদিকে যায়, আর নিম্নাংশ অন্যদিকে – ধরুন পা ফাইন-লেগের দিকে আর বাহু স্লিপের দিকে – তাহলে আপনার সামনের পা আপনার শরীরের ওজনের চারগুণ জোর নিয়ে মাটিতে পড়তে পারে ও আপনার শিরদাঁড়ায় মোচড় লাগতে পারে। কোচরা বোলারদের mixed action – নিতম্বের (hips) অংশে ছড়ানো (open) ও কাঁধের (shoulders) অংশে গোটানো (closed) – দেখে-জেনে-বুঝে প্র্রয়োজনীয় সংশোধন করাতে পারেন।

কিছু কিছু বোলার খুবই অপ্রচলিত (unorthodox) পদ্ধতিতে বোলিং করেছেন, উইকেট দখল করে সাফল্যও পেয়েছেন, যেমন মুরলিথরন, পল অ্যাডামস [নিশ্চয়ই মনে করতে পারছেন!], ম্যাক্স ওয়াকার [‘wrong foot’-এ বল ডেলিভারি করতেন ব’লে সহ-খেলোয়াড়রা ডাকতেন ‘Tangles’ নামে!] এঁরা। তো কোচদের কি উচিৎ তাঁদের বোলিং অ্যাকশন বদলে দেওয়া? 

নিছক বদলে দেওয়ার জন্যই বদলে দেওয়া, বা বায়োমেকানিক্স-জনিত কারণ হলেই বদলে দেওয়াটা ঠিক নয়। কায়দা পাল্টানোর বা সংশোধন করবার প্রধান কারণ হওয়া উচিত আরো ভাল ফললাভ। বোলার যদি ফলটা যথেষ্ট ভাল পেতে থাকেন, তাহলে তার দরকার নেই। 

কিন্তু এইসব বোলাররা গোড়া থেকেই এমন অদ্ভুত ভঙ্গিমা পেলেন কেমন করে? খুব সম্ভবত কম বয়সে তাঁরা সঠিক প্রশিক্ষণ-নির্দেশ পাননি, যা পেলে এঁরা হয়ত আরো সহজভাবে যথেষ্ট ভাল ফল পেতেই পারতেন। তবে পরিণত বয়সে এই বদল করা বেশ কঠিন কারণ কেরিয়ারের মাঝে পুরোন অভ্যেস ভুলে গিয়ে নতুন অভ্যেস রপ্ত করতে যাওয়ার ঝুঁকি প্রচুর, এমনকি কেরিয়ার শেষও হয়ে যেতে পারে।

ব্যাটিং

ব্যাটারদের এই জাতীয় চোট-আঘাতের সম্ভাবনা বোলারদের তুলনায় কম, কারণ (বোলিংয়ের তুলনায়) ব্যাটিংয়ে শরীরে ওপর ধকল অনেক কম পড়ে। যেসব ধরণের খেলায় আপনাকে বলকে মারতে হয়, আপনাকে প্রধানত সামনের দিকে এগোতে হয়। ক্রিকেটে কিন্তু তা হয়না, আপনাকে পিছোতেও হয়। ব্যাটারকে সাধারণত তাঁর শরীরের ওজন সামনে বা পেছনে সরিয়ে নিয়ে (transfer), তাঁর কব্জি, বাহু ও কাঁধ ব্যবহার করে বলটাকে মারতে হয় এবং দু’প্রান্তের উইকেটের মধ্যে দৌড়তে হয়, যার কোনটাই বিশাল ধকলের জিনিস নয়। কিন্তু ভুল কায়দা-কৌশল আপনাকে আউট করে দিতে পারে। সেটা কেমন করে?

একটু ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করা যাক। একজন টিপিক্যাল ভারতীয় উপমহাদেশীয় ব্যাটারের কথা ভাবা যাক। তাঁর কৌশল অনেকটাই এক প্রাথমিক সম্মুখবর্তী চলনের (initial forward movement) ওপর ভিত্তি ক’রে, কারণ তিনি তাঁর বেশিরভাগ ক্রিকেটই খেলেন ধীরগতির পিচে যেখানে বল কম লাফায় (low bounce)। তিনি যখন বাউন্সি পিচে খেলেন, তখন বেশ খানিকটা মুশকিলে পড়েন যেখানে (দ্রুতগতিতে) আগুয়ান এক উঠতি ডেলিভারির দিকে তিনি অভ্যেসবশতই একটু এগিয়ে গেছেন – ফলে বলটাকে নিচের জমির দিকে খেলতে তাঁর অসুবিধে হয়। তাঁর প্রাথমিক পশ্চাদবর্তী চলনের (initial backward movement) অভ্যেসটা থাকলে তিনি তুলনায় কম ঝামেলায় ঐরকম বলটাকে নিচের জমির দিকে খেলতে পারতেন।

একভাবে দেখলে সামনে এগোন কিন্তু পেছনে যাওয়ার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার শরীরের ওজন সামনের দিকে চলমান অবস্থায় পিছিয়ে যাওয়া কঠিন। সামনের পায়ে খেলা (playing forward) এমন কিছু দোষের নয়, কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে আপনি পিছিয়ে আসার আগে আপনার সামনের দিকের ঝোঁকটা বন্ধ করে দিতে হবে। ব্যাটার যদি প্রাথমিকভাবে পিছিয়ে গিয়ে থাকেন, তাঁর ওজন তখন তাঁর পেছনের পায়ে এবং তিনি কিন্তু তবুও তাঁর সামনের পা সরাতে পারেন কারণ তাতে ওজন অনেক কম। বলটা যদি তাঁর বেশ কাছে পড়ে (pitched well up), তিনি এগিয়ে গিয়ে খেলতে পারেন। যেহেতু তাঁর ওজন সামনের দিকে অত্যধিক ঝুঁকে যায়নি, তিনি চাইলে আরো পিছিয়ে গিয়ে পেছনের পায়ে শটও (back foot shot) খেলতে পারেন। ভাল করে দেখলে হয়ত খেয়াল করেছেন যে রাহুল দ্রাবিড়ের প্রাথমিক চলন ছিল পশ্চাদবর্তী।

বোলিংয়র ডেলিভারি ও ব্যাটিংয়ের প্রাথমিক সম্মুখবর্তী / পশ্চাদবর্তী চলনে বায়োমেকানিক্স ব্যাপারটার প্রয়োগ সামান্য কিছুটা বোঝাতে পারলাম আশাকরি। আজ এই পর্যন্তই থাক – পরের পর্বে ব্যাটিংয়ের গ্রিপ ও বোলিংয়ের সাইড-অন / চেস্ট-ওপেন অ্যাকশনের ওপর এর কিছু প্রভাব নিয়ে চর্চা করবার ইচ্ছে রইল।

[পুনশ্চ: ফ্র্যাঙ্ক টাইসনের কিছু রচনা ও সাক্ষাৎকারের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।]