‘বায়োমেকানিক্স’: ক্রিকেটে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ – প্রথম পর্ব

১৯৭৩-৭৪ মরসুমে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-মহলে আপাতদৃষ্টিতে অকিঞ্চিৎকর দুটো ঘটনা ঘটে।

(১) পার্থ শহরে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও বিনোদন বিভাগের (Department of Physical Education & Entertainment) এক অধ্যাপক ডঃ ফ্র্যঙ্ক পাইক ভার নেন তাঁর প্রাক্তন এক স্কুল-ছাত্র ডেনিস লিলি (নামটা চেনা-চেনা লাগছে কি!) নামক এক পেস বোলারের পিঠের চোট সারিয়ে তুলবার। 

(২) মেলবোর্ন শহরে ভিক্টোরিয়া দলের ক্রিকেট প্রশিক্ষণের ভারপ্রাপ্ত ফ্র্যাঙ্ক টাইসন (নামটা শুনেছেন তো!) নামক এক ইংরেজ ভদ্রলোক একটি নতুন বিষয়ে ওয়াকিবহাল হতে শুরু করেন। বিষয়টার নাম “Biomechanical Principles and their application in the game of Cricket” বা ঐজাতীয় একটা কিছু – শেখাচ্ছেন কেন ডেভিসের মত শারীরিক শিক্ষাবিদ। অস্ট্রেলিয়াতে তখন জাতীয় ক্রীড়া-প্রশিক্ষণ স্বীকৃতি প্রকল্প (National Coaching Accreditation Scheme) চালু হয়েছে – একটু সিনিয়র-লেভেলের কোচদের এইসব ব্যাপার বিষয়ে সচেতন করাও শুরু হয়েছে। 

প্রথম ঘটনাটার খানিকটা ফল এক বছরের মধ্যেই হাড়ে হাড়ে টের পেলেন ১৯৭৪-৭৫ মরসুমে অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে-আসা অস্ট্রেলিয়া সফররত মাইক ডেনেসের এম.সি.সি দলের ব্যাটাররা। ১৯৭৩-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে পিঠের যন্ত্রণায় জেরবার, কেবলমাত্র ব্যাাটার হিসেবে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ খেলতে বাধ্য হওয়া লিলি ঐ অ্যাশেজ সিরিজে ছ’টা টেস্টে চব্বিশেরও কম গড়ে পঁচিশটা উইকেট দখল করেন। আর নবোদিত আরেক ‘খামখেয়ালি’ পেসার টমসনের সঙ্গে জুটি বেঁধে সৃষ্টি করেন “লিলিয়ান টমসন” নামে এক মারাত্মক ‘দ্রুতগামিনী মহিলা’-র যাঁর প্রাণঘাতী ছোঁয়া ১৯৭৫-৭৬ মরসুমে অস্ট্রেলিয়া সফররত ক্লাইভ লয়েডের ক্যারিবিয়ান দলের দুরন্ত নির্ভীক  ব্যাটারদেরও এমন কাঁপিয়ে দেয় যে তার প্রভাবে ১৯৭৬ সাল থেকেই ক্রিকেট-দুনিয়ায় বোলিং আক্রমণের ধাঁচে এক দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন হয়। ক্রিকেট-বিশ্বের ব্যাটারদের কাছে সে এক ‘দুখভরি কহানি’!

দ্বিতীয় ঘটনাটার প্রভাব তুলনায় অনেক ধীরগামী, কিন্তু আরো অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী। প্রায় পাঁচ দশক বাদে আজ আমরা সবধরণের ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং করবার কায়দার যে ব্যাপক ভিডিও-বিশ্লেষণ দেখি, সেই মানসিকতার গোড়াপত্তন হয়ত সেখান থেকেই, যদিও এই দীর্ঘ সময়কালে অবধারিতভাবেই সেইসংক্রান্ত প্রযুক্তি বহুগুণে উন্নত হয়েছে। টাইসনের কথায়, “These methods have always been there but it’s just that we never used them.”

ছবি : ইন্টারনেট

এই ‘বায়োমেকানিক্স’ বস্তুটা কি? আজকের দুনিয়ায় অনেক ক্রীড়াপ্রেমীই, শুধু ক্রিকেটপ্রেমীই নন, উত্তরটা হয়ত জানেন, তবুও খুব সংক্ষেপে একটু বোঝাবার চেষ্টা করি – বায়োমেকানিক্স-বিশেষজ্ঞরা ধৈর্য ধরে একটু ক্ষমা-ঘেন্না করে সহ্য করে নিন।

এটা হচ্ছে “মানবদেহের নানা অংশে বিভিন্ন বলের (forces) প্রয়োগ ও তার প্রভাবসমূহ পরিমাপ (measurement)) ও মূল্যায়ন (assessment) করবার এক বিজ্ঞান” – পদার্থবিদ্যার (Physics) একটা বিশেষ শাখা বলা যেতে পারে। ক্রীড়া কৌশল (sporting techniques) মূল্যায়নের এটাই সম্ভবত এক যুক্তিসঙ্গত ও কার্যকরী পন্থা, যা প্রশিক্ষণ থেকে নিছক অনুমান জিনিসটাকে সরিয়ে দিতে বলে। সাহেবি ঢংয়ে জানাই: “It enables us to look at the techniques employed by sportsmen and to then put them in context of the laws of physics, and assess whether that’s the most effective or efficient way to perform that skill. Nowadays, we can not only assess, we can also measure and record, computerise and analyse. It sounds rather bloodless and unartistic, but it’s an efficient way of measuring how much a person digresses from the ideal performance.”

ক্রিকেটে এটা কেমনভাবে প্রয়োগ করা যায়? ব্যাটার ও বোলারদের পারফরমেন্সের ভিডিও রেকর্ডিং দেখে, বিশ্লেষণ করে এবং ‘আদর্শ’ বস্তুটার সঙ্গে তুলনা ক’রে কৌশলগত ভুলত্রুটি বিচার ক’রে ‘সঠিক’ কায়দাটা রপ্ত করবার চেষ্টা – এই হ’ল সার কথা। এটা অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত, কারণ পরিমাপ-পদ্ধতি অনেক বেশি যথাযথ (accurate), আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে।

উদাহরণ স্বরূপ, ধরা যাক ব্যাটের ফলো-থ্রু। এটি তো হয় ব্যাটার তাঁর শটটি খেলার পরে, তাহলে এর ভূমিকাটা কি? 

কোনও ব্যাটারের ফলো-থ্রু যদি মিড-উইকেটের (ফিল্ডিং পোজিশন) দিকে যায়, তাহ’লে বলা যেতে পারে যে ব্যাটে-বলে হওয়ার সময় ব্যাটের গতিপথ (swing of bat) বলের লাইনের প্রায় সম্পূর্ণ আড়াআড়ি (diametrically across) ছিল। তার মানে ব্যাটের ব্যাক-লিফ্ট সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্লিপের দিক থেকে ছিল এবং তা হয়ত অত্যধিক বটম-হ্যান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

সামনের পায়ে ড্রাইভের (front-foot drive) ক্ষেত্রে, ফলো-থ্রু যদি ছোট ও প্রায় না-থাকার মতন হয়, তাহ’লে বলা যেতে পারে যে ব্যাটে-বলে হওয়ার সময় আসলে ব্যাটের গতি কমছিল, এবং শটের পেছনে জোর তুলনামলকভাবে কম ছিল। এর উন্নতি করতে গেলে ব্যাটের গতিপথ আরো দীর্ঘ (fuller) ও খোলামেলা (freer) করা উচিত।

বোলিংয়ের ক্ষেত্রে সামনের পায়ের হাঁটুর কথাই ধরুন। তা যদি বেশি ভাঁজ হয় এবং পায়ের পাতা ও ডেলিভারি-করা হাতের মধ্যে দূরত্ব কমে যায়, বল ডেলিভারি করার সময় বোলারের উচ্চতা কমবে ও হাতটি কিছুটা ছোট বৃত্তাকারে ঘুরবে। বোলিংয়ে হাত ঘোরানোর বৃত্তাকারটা (arc of swing) যত দীর্ঘ হবে, বৃত্তাকারটা তত বেশি গতিশীল হবে।

ব্যাটিংও একই জাতীয় ব্যাপার। আপনি যদি ব্যাটের হাতলের ওপরের শেষপ্রান্তটা ধরেন, ব্যাটের হাতলের নিচের প্রান্তটার বদলে, তাহলে ব্যাটের বৃত্তাকার গতিপথটা দীর্ঘতর, অতএব দ্রুততর হবে; আর বলটাকে বেশি জোরে মারা যাবে।

ক্রিকেটে বায়োমেকানিক্স ব্যাপারটার প্রয়োগ সামান্য কিছুটা বোঝাতে পারলাম আশাকরি। আজ এই পর্যন্তই থাক – পরের পর্বে ব্যাটিং ও বোলিংয়ের ওপর এর আরো কিছু প্রভাব নিয়ে চর্চা করবার ইচ্ছে রইল।

[পুনশ্চ: ফ্র্যাঙ্ক টাইসনের কিছু রচনা ও সাক্ষাৎকারের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।]