বাবর আজম এবং বাবর আজমরা

২০০১-এর সেই বিখ্যাত কলকাতা টেস্টের প্রথম দিন সৌরভ গাঙ্গুলির বলে আউট হয়ে ক্যাসপ্রভিচ যখন ফিরে যাচ্ছিলেন তখন উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা স্টিভ ওয়াঘ-এর রান ৩৫-এর পাশেপাশে। এরপর গিলেসপি এবং ম্যাকগ্রাথকে সঙ্গে নিয়ে তিনি লম্বা ইনিংস খেলেন। তখন বলা হয়ে ছিল ব্যাটারের নাম স্টিভ ওয়াঘ বলেই এমন ইনিংস খেলা সম্ভব হয়েছে।

২০২২-এর গলের পরিস্থিতি কিন্তু অনেকটাই অন্যরকম। বাবরের উল্টোদিকে ছিলেন না কোন জেসন গিলেসপি, যিনি কিছুটা ব্যাটিং করতে জানেন। পকেটে ছিল না স্টিভের মতো প্রায় দেড়শ টেস্ট খেলার বিপুল অভিজ্ঞতা। আর এটাই ছিল শেষ জুটি। এমতাবস্থায় রবিবার এই ভরা টি২০র বাজারে ধৈর্য্য ধরে যে ইনিংসটা খেললেন বাবর, সেটা এককথায় তুলনাহীন। হরভজন-লক্ষণ চিত্রনাট্যে না ঢুকে পড়লে স্টিভই হয়তো হতেন কলকাতা টেস্টের নায়ক। অনেকটা একই রকমভাবে গল টেস্টেও হয়তো নায়ক হওয়া হবে না বাবরের। এরকম একটা ইনিংস খেলার পরেও থেকে যাবেন বিজিতের দলে যদি না দ্বিতীয় ইনিংসে আবার একটা কালজয়ী ইনিংস তিনি খেলেন।

আসলে এটাই সম্ভবত বাবর আজম। পারফরম্যান্স বলছে তিনি এযুগের ফ্যাব ফাইব ব্যাটারের একজন। গলের এই ইনিংস চলাকালীনই তো এশিয়ার দ্রুততম ব্যাটার হিসেবে সব ফরম্যাট মিলিয়ে দশ হাজার রানে পৌঁছলেন, পেছনে ফেললেন বিরাট কোহলিকে। কিন্তু তাও যেন মনে হয় কোথাও একটা তিনি পিছিয়ে বাকিদের তুলনায়, একটু-আধটু নয়, অনেকটাই পিছিয়ে। ফ্যাব ফাইবের বাকি চারজনের মধ্যে দুজন অর্থাৎ কেন উইলিয়ামসন এবং জো রুটের স্ট্যাট দেখলে দেশ এবং দেশের বাইরের পারফরম্যান্সের মধ্যে বিস্তর ফারাক খুঁজে পাওয়া যাবে। অথচ বাবর সব ফরম্যাট মিলিয়ে দশ হাজার রান করতে রুটের থেকে মাত্র ৬টি ম্যাচ বেশী নিলেন! ‘হোম ট্র্যাক বুলি’ বলে যতই গেলো গেলো করি না কেন, সেটা হয়তো ব্যর্থতা কিন্তু কোন ভাবে অন্যায় নয়। তুলনায় বিরাট-স্মিথের পারফরম্যান্সের মধ্যে অনেক বেশী সামঞ্জস্য রয়েছে, বিশেষত স্মিথের। হোম কন্ডিশনের বাড়তি সুবিধে সব খেলোয়াড়ই পেতে চান।  তবে সে যাই হোক না কেন স্ট্যাটের খাতায় কিন্তু সব রানের গুরুত্বই সমান। আর এখানেই পিছিয়ে পড়ছেন বাবর। বাবর সম্ভবত প্রথম খেলোয়াড় যিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব ফরম্যাট মিলিয়ে দশ হাজার রান করে ফেললেন অথচ তাঁর দেশের মাটিতে কোন ফরম্যাটেই নূন্যতম এক হাজার রান করেননি।

বাকিরা যখন দেশের মাঠে, চেনা পরিবেশে বড় রান করে নিজের বিদেশ সফরের সামান্যতম খামতিও মেরামত করে ফেলছেন, সেখানে বাবর দেশের মাঠে বা  বলা ভালো প্রিয় মৃগয়াক্ষেত্রে খেলার সুযোগই পান না। তাঁর খেলা একচল্লিশটা টেস্টের মধ্যে খাতায় কলমে মাত্র আটটা খেলেছেন দেশের মাঠে! ভাবতে পারবেন রুট, বিরাটরা! একই অবস্থা সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও। একদিনের অন্তর্জাতিকের ক্ষেত্রে অনুপাত ৭৭:১২, এই ফরম্যাটে মোট রানের আশি শতাংশ এসেছে বিদেশের মাঠ থেকে। তা সত্ত্বেও তিনি  সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে চলেছেন সমসাময়িক দুনিয়ার বাকি চার সেরা ব্যাটারের সঙ্গে, যাঁরা প্রচুর রান করেছেন বা করছেন তাদের হোম কন্ডিশন থেকে। লড়ে যাচ্ছেন শুধু প্রতিভা আর পরিশ্রমের জোরে, ভাগ্যের একটু সহযোগিতা ছাড়া। 

বাবর যেন এযুগের ক্রিকেটের কর্ণ। ভাগ্য যাঁর কর্মকে,কর্মফলকে অনেকটাই প্রভাবিত করছে, নিয়ন্ত্রণ করছে, প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ব্যাটার হিসেবে চূড়ান্ত শিখরে উঠতে। তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের বছর ছয়েক আগেই কিছু মুখোশ ও বন্দুকধারী মানুষ লাহোরের রাস্তায় লিখে দিয়েছিল তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের একটা বড় অধ্যায়। যাকে নিয়ন্ত্রন বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা ছিল না বাবরের। তা সত্ত্বেও এই অসম লড়াই সমান ভাবে লড়ে চলেছেন বাকি চার জনের সঙ্গে। এই অসম লড়াই শুধু বাবরের একার নয়, তাঁর সমস্ত সতীর্থের।

আজ নয়, হয়তো কিছু বছর পরে, ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া বাবর আজম কোন এক সন্ধ্যায় লাহোর বা দুবাইয়ের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে নিজেই নিজেকে প্রশ্নটা করবেন। কেন তাঁর এই অসম লড়াই? এর উত্তর তিনি খুঁজে পাবেন কিনা জানি না, তবে এর উত্তর অবশ্যই লুকিয়ে আছে সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, সভ্যতার কাছে।