আচ্ছা আমাদের দেশপ্রেম কি এতটাই ঠুনকো?
ওয়াঘার ওপারের দেশকে যে কোনও খেলাতে হারাতে পারলেই আমাদের দেশপ্রেম উপচে ওঠে। আর হারলে? একাংশের দেশপ্রেমের মুখোশ নিজেদের অজান্তেই খসে যায়! বেরিয়ে আসে কুৎসিত মুখ। ঠিক যেমনটা হল ভারতের তরুণ জোরে বোলার অর্শদীপ সিংয়ের সঙ্গে।
এশিয়া কাপের সুপার ফোরের ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে হেরেছে ভারত। ব্যস। দেশভক্তদের কাছে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণের কেন্দ্রে অর্শদীপ। তাঁর দোষ? পাকিস্তান ইনিংসের ১৮তম ওভারে তিনি আসিফ আলির ক্যাচ ফেলেছিলেন। তাই হারের পর ভয়ঙ্কর ট্রোলড হলেন অর্শদীপ। যারা ট্রোল করল, বিদ্বেষ ছড়াল, বেমালুম ভুলে গেল যে, শেষ ওভারে পাকিস্তানের জেতার জন্য দরকার ছিল ৭ রান, ‘ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট’ অর্শদীপ সেই ম্যাচকেই টেনে নিয়ে গেলেন পঞ্চম বল পর্যন্ত। কিন্তু হায়, তাঁকে উদ্দেশ্য করে যেমন গালিগালাজ বর্ষিত হল, তীব্র ঘৃণার মুখে পড়তে হল অর্শদীপের পরিবারকেও! কিন্তু তার থেকেও যেটা মারাত্মক, বাঁহাতি জোরে বোলারের উইকিপিডিয়া পেজ এডিট করে ভারতের নাম সরিয়ে তাঁকে দেখানো হল ‘খালিস্তানি’ হিসেবে! এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারও। উইকিপিডিয়ার আধিকারিকদের ডেকে ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক। এই ঘটনায় অনেকগুলো আশঙ্কা ছিল। ভারত–পাক, দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে পারে, সমস্যা হতে পারে আইনশৃঙ্খলার। ফলে ঘটনার গুরুত্ব বিচার করেই তথ্য বিকৃতি সংশোধন করে উইকিপিডিয়া কর্তৃপক্ষ। অতীতে ঠিক একই কায়দায় সংগঠিত প্রচারে মহম্মদ সামির ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করে তাঁর বিরুদ্ধেও জঘন্য আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছিল। এখানেই উঠছে প্রশ্ন। দেশপ্রেমের বড়াই করা ‘আমরা’ কি এতটাই নীচে নামতে পারি?
মুদ্রার উল্টো পিঠ বরং অনেক আশার সঞ্চার করে। সুস্থ মানসিকতায় বাঁচতে রসদ জোগায়। এই তো সেদিন চোট পেয়ে এশিয়া কাপ থেকে ছিটকে যাওয়া পাক জোরে বোলার শাহিন শা আফ্রিদিকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন যুজবেন্দ্র চাহাল। দুবাই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে হাত মিলিয়ে শাহিনকে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার শুভেচ্ছা জানালেন বিরাট কোহলি। পাল্টা সৌজন্যে শাহিনের শুভেচ্ছা, দ্রুত রানে ফিরুন বিরাট। অনুশীলনে নামার আগে গল্প জুড়েছেন বিরাট–বাবর, রোহিত–বাবর, এই ছবিও তো ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। কমেন্ট্রি বক্সে গায়ে গা লাগিয়ে বসে ভারত–পাক ম্যাচের উত্তেজনার স্বাদ নিচ্ছেন সঞ্জয় মঞ্জরেকার, গৌতম গম্ভীর, ওয়াসিম আক্রামরা। সেদিন জানা গেল পাক ক্রিকেটের কিংবদন্তি, অসুস্থ জাহির আব্বাসকে লন্ডনের হাসপাতালে গিয়ে দেখে এসেছেন সুনীল গাভাসকার।
আশার আলো আরও আছে। এদেশেই প্রতিবাদে সামিল অনেকে। বর্তমান থেকে প্রাক্তন, ভারতীয় ক্রিকেটাররা পাশে দাঁড়িয়েছেন অর্শদীপের। বিরাট বলেছেন, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ম্যাচে শাহিদ আফ্রিদির বলে খারাপ শট খেলে আউট হয়েছিলাম। রাতে ঘুমোতে পারিনি। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমার ক্রিকেট জীবনই শেষ হয়ে গেল।’ হরভজন সিংয়ের কথায়, ‘অর্শদীপের সমালোচনা বন্ধ করুন। কেউ ইচ্ছে করে ক্যাচ ফেলে না। যারা এসব বলছে, তাদের লজ্জা হওয়া উচিত।’ উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন অলরাউন্ডার মহম্মদ হাফিজ। তাঁর টুইট, ‘খেলায় সবাই ভুল করে। কিন্তু ভুললে চলবে না আমরাও রক্তমাংসের মানুষ। এভাবে কাউকে অপমান করা ঠিক নয়।’
অর্শদীপকে একটাই অনুরোধ। এসব আপনি মনে রাখবেন না প্লিজ। বিকৃত রুচি, বিকৃত চিন্তা, বিকৃত মনন কখনও জেতে না। আপনার পাশে দাঁড়িয়ে যেভাবে সমর্থনের ঢেউ উঠেছে, তা আপনার মানসিকতাকে ইস্পাতদৃঢ় করুক। ভবিষ্যতে তেরঙাকে গর্বিত করুন। আপনার বিষাক্ত সুইংয়ে বিধ্বস্ত হোক দেশপ্রেমের চাদর জড়িয়ে থাকা ভণ্ডরা।