মাস ছয় আগের কথা। ভারতীয় দল তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। শেষ টেস্টের আগেই জোর জল্পনা, দুজনের টেস্ট কেরিয়ারে হয়ত যবনিকা পড়তে চলেছে। এই দুজন হলেন চেতেশ্বর পূজারা ও অজিঙ্কা রাহানে। এমনকি ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে সুনীল গাভাসকার পর্যন্ত বলে বসলেন, টেস্ট কেরিয়ার বাঁচানোর শেষ সুযোগ পূজারা আর রাহানের কাছে। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে না পারলে ওরা হয়ত খুব দ্রুত প্রাক্তন হয়ে যাবে।
সেই সিরিজে একেবারেই ব্যর্থ মিডল অর্ডারের এই দুই ব্যাটার। ছয় ইনিংসে দুজনের ব্যাট থেকেই এসেছিল একটি করে হাফ-সেঞ্চুরি। দেওয়াল লিখনটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। দেশে ফিরেই বাদ পড়তে চলেছেন এই দুই সিনিয়র ক্রিকেটার। সেটাই হল। ঘরের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজে জায়গা হল না এই দুই ক্রিকেটারের। দক্ষিণ আফ্রিকার সবুজ ও গতিময় উইকেটে তাঁদের ব্যর্থ হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হল। কিন্তু ঘরের মাটিতে, সহজ উইকেটে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগটাই পেলেন না।
একদিনের ক্রিকেট বা টি২০ তে এই দুজন মোটেই অপরিহার্য নন। আগে যেটুকু ছিলেন, এখন তার ছায়াও নন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে ক্ষিপ্রতা। তারুণ্যের জোয়ারে স্বভাবতই ভেসে যাওয়ার কথা এই দুই টেস্ট স্পেশ্যালিস্টের। আইপিএলের ভরা বাজারে পূজারা আগেই কিছুটা ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন। গতবছর নাম কে ওয়াস্তে উপস্থিতি থাকলেও এবার সেটুকুও রইল না। ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ন্ত্রিত আইপিএলের এই নির্মম দুনিয়ায় ‘আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে’ না আউড়ে অন্য একটা বিকল্প রাস্তাই খুঁজে নিতে হত পূজারাকে। তাই ঠিক করলেন, ধর তক্তা মার পেরেকের আইপিএল নয়। তাঁর নিজেকে মেলে ধরার একমাত্র মঞ্চ হতে পারে কাউন্টি ক্রিকেট। সাসেক্স থেকে প্রস্তাবটাও ঠিক তখনই এল। আইপিএলের আলোকবৃত্ত থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন। তিনি চললেন সাবেকি ক্রিকেটের সেই প্রান্তিক দুনিয়ায়।
অন্যদিকে, রাহানে রইলেন আইপিলের আবহেই। জার্সি বদল করে এবার তিনি কলকাতা নাইট রাইডার্সে। নিলামেও তাঁকে নিয়ে কোনও কাড়াকাড়ি ছিল না। নমো নমো করে দর উঠল মাত্র এক কোটি। অখ্যাতরা বিকিয়ে গেলেন আট কোটি, দশ কোটিতে। সেখানে এমন তারকার দর কিনা মাত্র এক কোটি! তাঁকে ঘিরে বিরাট কোনও প্রত্যাশা ছিল না। কারণ, আইপিএলের বাজারে তিনি বড়জোর কাজ চালানো একজন ক্রিকেটার। বিরাট ঝড় তুলবেন, এতখানি নিজেও ভাবেননি। তাই বলে এতখানি হতাশ করবেন, এটাই বা কে ভেবেছিল! সাত ম্যাচে পেলেন মাত্র ১৩৩ রান। একটিও পঞ্চাশ নেই। গড়ও কুড়ির নিচে। হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে ছিটকেই গেলেন। মাঝপথেই আইপিএল থেকে বিদায়। টি২০ দলে অন্তর্ভুক্তির ন্যূনতম সম্ভাবনাও ছিল না। এমনকি খুলল না টেস্ট দলের দরজাও।
আরেকদিকে পূজারা। রঞ্জিতে মোটামুটি রান পেয়েছেন। নিরাশ করেননি। কাউন্টিতে কতটা সফল হতে পারবেন, সংশয় ছিলই। প্রথম ইনিংসেই চূড়ান্ত ব্যর্থ। ঘুরে দাঁড়ালেন দ্বিতীয় ইনিংসেই। পেলেন দুরন্ত ডাবল সেঞ্চুরি। সবমিলিয়ে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি, দুটি সেঞ্চুরি–সহ ৭২০ রান। ভারতের মূলস্রোত মিডিয়ায় এই দুরন্ত সাফল্য তেমন কোনও গুরুত্বই পেল না। কিন্তু নজর রেখেছিলেন নির্বাচকরা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জুলাইয়ে একমাত্র টেস্টের দল বাছার সময় তাই তাঁর নামটা ভুলে যাননি। সসম্মানেই ফিরিয়ে নেওয়া হল পূজারাকে।
ভারতীয় ক্রিকেটে বাদ গিয়ে আবার ফিরে আসা নতুন কিছু নয়। কিন্তু অন্যদের ফিরে আসার সঙ্গে পূজারার এই প্রত্যাবর্তনের ফারাক আছে। কারণ, ৯৫ টেস্ট খেলা ৩৫ বছরের পূজারাকে প্রায় বাতিলের খাতাতেই ফেলা হয়েছিল। যদিও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজে বাদ দেওয়ার সময় নির্বাচকদের দিক থেকে বলা হয়েছিল, ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করে পূজারা বা রাহানে আবার ফিরে আসতেই পারেন। কিন্তু সে তো কথার কথা। মুখের ওপর তো আর বলা যায় না যে, তাঁদের জন্য দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এভাবেই কত ক্রিকেট জীবন মাঝপথেই থমকে গেছে। কত ক্রিকেটার বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন। পরে এমন সময় অবসর ঘোষণা করেছেন, কাগজে টুকরো খবর হয়ে বেরিয়েছে। এমনকি ছবিটুকুও ছাপা হয়নি। পূজারাও হয়ত সেভাবেই হারিয়ে যেতেন। কিন্তু একটা লাইফ-লাইন পেলেন। সিনিয়র খেলোয়াড় পূজারাকে ইংল্যান্ডে উড়িয়ে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ধরে নেওয়াই যায়, প্রথম একাদশে থাকছেন। মোটামুটি সফল হলে একশো টেস্ট পর্যন্তও দেখতে পারেন নির্বাচকরা।