বিনা শতকেই পাঁচশো পার, শূন্য ছাড়াই অন্ধকার

গত সপ্তাহের ঠিক আজকের দিনেই “উইলোর উইল”-এ একটা রচনা প্রকাশিত হয়েছে, বিষয়বস্তু ছিল কোনও ব্যক্তিগত শতরান ছাড়াই প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচের সর্বোচ্চ দলীয় ইনিংস নিয়ে – পড়েছেন নিশ্চয়ই সেই রচনাটা। [https://willowrwill.com/2022/05/17/record-by-surrey/]

বিনা শতকেই পাঁচশো পার 

আজকে একটু চোখ রাখা যাক টেস্ট-ক্রিকেটের আঙ্গিনায় – ব্যক্তিগত কোনও শতরান ছাড়াই ‘বড়’ (৫০০ বা তার বেশি) রানের দলীয় ইনিংসের ঘটনা নিয়ে। এমনটা আজ পর্যন্ত ঘটেছে অন্ততপক্ষে চার বার – প্রতি দশকে এক বার ক’রে।

১৯৮০-র দশকে প্রথমে ব্যাটিং-করা পাকিস্তান দলের অধিনায়ক জাভেদ মিয়াঁদাদ ইনিংস ডিক্লেয়ার করেন ৫০০/৮ রানে, সর্বোচ্চ ইনিংস খেলেন মুদাসসার নজর (৯৫), তাছাড়া আরও পাঁচটা অর্ধশতরান হয়েছিল – জাহির আব্বাস (৯০), মজিদ খান (৭৪), ইমরান খান (৭০), মিয়াঁদাদ (৬২), ওয়াসিম রাজা (৫০) – বিপক্ষ ছিল লিলি-টমসন-অল্ডারম্যান-ইয়ার্ডলি সমেত গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়া, স্থান মেলবোর্ন, কাল ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর। 

১৯৯০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫১৭ রান [ব্রায়ান ম্যাকমিলান (৮৭*), গ্যারি কার্স্টেন (৭৭), হান্সি ক্রোনিয়ে (৭৩), অ্যাডাম বাখার (৬৪), প্যাট সিমকক্স (৫০)], বিপক্ষ মার্ক টেলর-এর ম্যাকগ্রা-বিহীন-ওয়ার্ন-সমেত অস্ট্রেলিয়া, স্থান অ্যাডিলেড, কাল ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি।

২০০০-এর দশকে প্রথমে ব্যাটিং-করা অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক রিকি পন্টিং ইনিংস ডিক্লেয়ার করেন ৫২০/৭ রানে [সাইমন ক্যাটিচ (৯৯), শেন ওয়াটসন (৮৯), ব্র্যাড হ্যাডিন (৮৮), মাইকেল হাসি (৮২), মার্কাস নর্থ (৬৮)], বিপক্ষ ক্রিস গেইল-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ, স্থান পার্থ, কাল ২০০৯ সালের ডিসেম্বর।

এই তিনবারই এমন নাটক ঘটেছে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে, অতএব অজিরা থেকেইছে কুশীলবদের তালিকায়। কিন্তু টেস্ট-ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বার এমনটা ঘটেছিল ভারতের মাটিতে, ১৯৭০-এর দশকে এবং আজ পর্যন্ত সেই ইনিংসটাই এইধরণের সর্বোচ্চ ইনিংস হয়ে রয়েছে বিগত সাড়ে-চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। স্থান কানপুর, কাল ১৯৭৬ সালের নভেম্বর। ভারতের বিপক্ষ ছিল গ্লেন টার্নার-এর হ্যাডলি-সমেত নিউজিল্যান্ড দল। টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে বিষাণ সিং বেদির ভারতীয় দল ১৬৮ ওভার খেলে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে ৫২৪/৯ রানে – ছ’জন অর্ধশতরান করেন – মহিন্দর অমরনাথ (৭০), গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ (৬৮), সুনীল গাভাস্কর (৬৬), সৈয়দ কিরমানি (৬৪), অশোক মানকড় (৫০) এবং বেদি (৫০*) যা তাঁর টেস্ট-জীবনের একমাত্র হাফ-সেঞ্চুরি – সপ্তম অর্ধশতকটা ফসকান অংশুমান গায়কোয়াড় (৪৩), উনি আর সাতটা রান করতে পারলে একটা বিশ্বরেকর্ড হয়ে যেত, প্রথমবার এক টেস্ট-ইনিংসে সাতজনের অর্ধশতক, কোনও শতক ছাড়াই। এই ইনিংসে ভারতের কেউ সেঞ্চুরি করতে না পারলেও কিউয়িদের তিনজন বোলার তা করেছিলেন – স্পিনারদ্বয় ডেভিড ও’সুলিভান (৫০-১৪-১২৫-৩) ও পিটার পেথেরিক (৪৫-১২-১০৯-৩) এবং পেসার রিচার্ড হ্যাডলি (২৯-২-১২১-১) – সঙ্গের ছবি তিনটে দেখুন!

শূন্য ছাড়াই অন্ধকার

এবার একটু চোখ ফেরানো যাক অন্য প্রান্তে  – ব্যক্তিগত কোনও শূন্যরান (যাকে বলে ‘গোল্লা’) ছাড়াই ‘ছোট’ (১০০-রও কম) রানের দলীয় টেস্ট ইনিংসের ঘটনা নিয়ে। এমনটা আজ পর্যন্ত ঘটেছে অন্ততপক্ষে তিন বার, যার মধ্যে প্রথম দু’টো ঘটে পরপর দু’বছরে! তবে আশ্বস্ত হওয়ার বিষয় এই যে এখানে ভারতীয় দলের কোনও ‘হিস্যা’ নেই, যদিও এখানেও অজিদের উপস্থিতি জোরদার!!

১৯৫০-এর দশকের শুরুতেই, ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে ডারবানে লিন্ডসে হ্যাসেটের অস্ট্রেলিয়া দল, বিপক্ষ ডাডলি নর্স-এর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইনিংসের ৩১১ রানের জবাবে, ২৮.৪ ওভারে ৭৫ রানে ইনিংস শেষ করে। এই ইনিংসে প্রথম উইকেট পড়ে ৩১ রানে (জ্যাক মোরোনি ১০ রান ক’রে আউট), কিন্তু আর মাত্র ৪৪ রানে বাকি ন’টা উইকেট পড়ে – ডান-হাতি অফ-স্পিনার হিউ টেফিল্ড (৭-২৩) ও বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিনার টাফ্টি ম্যান (৩-৩১) ধ্বসিয়ে দেন। অজিদের সর্বোচ্চ ২৫ রান করেন ওপেনার আর্থার মোরিস, দশম ব্যাটার স্যাম লক্সটন করেন ১৬ রান; অতিরিক্ত চার রান বাদ দিলে বাকিদের মধ্যে রে লিন্ডওয়াল করেন ৭ রান, এবং বাকি ১৩ রান ‘সমানভাবে’ ভাগাভাগি করে নেন ইয়ান জনসন, কিথ মিলার, অধিনায়ক হ্যাসেট, উইকেট-রক্ষক রন স্যাগার্স, নিল হার্ভে, অপরাজিত বিল জনস্টন ও কলিন ম্যাককুল। “সাত দু’গুণে চোদ্দ”-র অঙ্ক মিলছে না তো? ম্যাককুল এক রান করেছিলেন, তাই! মজার ব্যাপার হচ্ছে যে এই ম্যাচ কিন্তু অজিরা জিতেছিল, পাঁচ উইকেটে – জিতিয়েছিলেন তৃতীয় ইনিংসে বোলিংয়ে জনসন (৫-৩৪) ও জনস্টন (৪-৩৯) এবং চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিংয়ে হার্ভে (১৫১*), ৯৫-৪ থেকে ৩৩৬-৫ অবস্থায় টেনে নিয়ে, লক্সটন (৫৪) ও ম্যাককুল (৩৯*) এই দু’জনের সহায়তায়।

এরই পরের বছরের শেষপ্রান্তে, ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে অ্যাডিলেডে (অসুস্থ হ্যাসেটের পরিবর্ত) অধিনায়ক মোরিসের অস্ট্রেলিয়া দল, বিপক্ষ জন গডার্ড-এর ওরেল-উইকস-স্টলমেয়ার-ক্রিশ্চিয়ানি-গোমেজ-রামাধীন-ভ্যালেন্টাইন সম্বলিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ৮২ রানে ইনিংস শেষ করে – ধ্বংসকারী বোলার ওরেল (৬-৩৮) ও গডার্ড (৩-৩৬) – রাম-ভ্যাল বল করবার সুযোগই পাননি। অজিদের সর্বোচ্চ ২৩ রান করেন ডান-হাতি ব্যাটার গ্রেম হোল, জনসন (১১) ও হার্ভে (১০) দু’অঙ্কে ঢোকেন; অতিরিক্ত তিন রান বাদ দিলে বাকিদের [জিম বার্ক, মোরিস, মিলার, লিন্ডওয়াল, ডাগ রিং, গিল ল্যাংলে, জেফ নোবলেট, জনস্টন] রান দেখতে যেন ল্যান্ড-লাইন টেলিফোন নাম্বার ৩-১-৪-২-৫-৫-৮-৭, জনস্টন অবশ্য নট আউট থাকেন। এই ম্যাচ অজিরা হেরেছিল, ছ’উইকেটে। উল্লেখযোগ্য এই যে ম্যাচের প্রথম দিনেই ২২টা উইকেট পড়ে – [তখন অস্ট্রেলিয়াতে আট বলের ওভার ছিল] অস্ট্রেলিয়া ৮২ (২৫.৭), ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১০৫ (২৪.৫ ওভার), অস্ট্রেলিয়া ২০-২  – ২০৭ রানে!

তারপর দীর্ঘ সাড়ে-পাঁচ দশকেরও পরে, ২০০৭ সালের জুন মাসে, আবার ঘটেছিল এমন ব্যাপার। যুযুধান দুই দল ভারতীয় উপ-মহাদেশেরই, (মহেলা জয়বর্ধনের) শ্রীলঙ্কা ও (মহম্মদ আশরাফুলের) বাংলাদেশ, অকুস্থল কলম্বো। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৭.৩ ওভারে ২৮ রানের মাথায় প্রথম উইকেট হারায় (শাহরিয়ার নাফিস ১৫ রান ক’রে মালিঙ্গা-র বলে আউট), ঐ রানেই ৮.৩ ওভারে অপর ওপেনার জাভেদ ওমর ৮ রান ক’রে ভাস-এর বলে আউট। এরপর খেল শুরু করেন মুরলিথরন (৫-১৫) ও দিলহারা ফার্নান্ডো (৩-৩৩) – আরো ২৪ ওভারে ৬১ রান যোগ করার পথে বাংলাদেশ বাকি আটটা উইকেট হারায়। মোট ৮৯ রানের মধ্যে চারজনে মিলে করেন ৫৪ রান – শাকিব-আল-হাসান (১৬), নাফিস (১৫), খালেদ মাসুদ (১২*), মহম্মদ রফিক (১১) – অতিরিক্ত হয় ৯ রান – বাদবাকি ২৬ রান এসেছিল বাকি সাত ব্যাটারের থেকে, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ৮ রান (ওমর) ও সবচেয়ে কম ছিল ১ রান (শাহাদাত হোসেন ও মাশরাফে মোর্তাজা); আশরাফুল (৭), আবদুর রাজ্জাক (৪), রাজিন সালে (৩), হাবিবুল বাশার (২) সবাই ব্যর্থ হন কিন্তু একজন ব্যাটারও ‘গোল্লা’ করেননি। তবে এই ম্যাচ শ্রীলঙ্কা জিতেছিল ইনিংস ও ২৩৪ রানে।