একটা ছবি যেন ম্লান করে দিল সব লড়াইকে

তখন সবে শেষ হয়েছে ভারত—পাক ম্যাচ। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ বলে কথা। তার ওপর সামনে পাকিস্তান। প্রথম ম্যাচেই দুরন্ত জয়। আর কী চাই! কিন্তু সেই জয়কে যেন ছাপিয়ে গেল সম্প্রীতির ছবিটা। তখন কে নায়ক, কে কত রান করলেন, কে কটা উইকেট নিলেন,  এই তথ্যগুলো এক লহমায় অনেকটা পেছনে চলে গেল। একটি ছবি যেন হাজার শব্দের সমান। 

ছবিটা আসলে কী? দেখা যাচ্ছে ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে আছেন পাকিস্তানের অধিনায়ক বিসমা মাহ্রুফ। আর তাঁকে ঘিরে আছেন নীল জার্সিধারী ভারতের ক্রিকেটাররা। আছেন হরমনপ্রীত কাউর, স্মৃতি মানধানা, দীপ্তি শর্মা, রিচা ঘোষ—সহ সাত ভারতীয় ক্রিকেটার। কেউ ছোট্ট ফতিমার গাল টিপে দিচ্ছেন। কেউ তার হাত ধরে আছেন। যেন মায়ের কোলে আছে ছোট্ট ফতিমা, আর ঘিরে আছেন মাসিরা। 

ছবি : আইসিসি

বিসমা মাহ্রুফ। মেয়েদের ক্রিকেটে নামটা বেশ পরিচিত। পাকিস্তানের জার্সি গায়ে এই লড়াকু মেয়ের পথ চলা শুরু এখন থেকে ষোল বছর আগে। এই ষোল বছরে ১০৮ একদিনের ম্যাচ যেমন খেলেছেন, তেমনই খেলেছেন ১০৮ টি২০ ম্যাচ। ব্যাট করেন বাঁ হাতে। কিন্তু লেগ স্পিন করেন ডান হাতে। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম ক্রিকেটার যিনি একদিনের ক্রিকেটে হাজার রানের গন্ডি পেরিয়েছেন। লাহোরের এই ক্রিকেটার একসময় ভেবেছিলেন, ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াবেন। সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর অনেকদিন ক্রিকেট থেকে দূরেও ছিলেন। গতবছর আগস্ট মাসে হল ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে। সংসারে নতুন অতিথি। মায়ের এতরকম দায়িত্ব। এদিকে বয়সও তিরিশ পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে আবার ক্রিকেটে ফিরতে পারবেন? সংশয় তো ছিলই।  

সব সংশয়কে দূর করে ঠিক করলেন, একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক। আবার একটু একটু করে ফিরে এলেন মূলস্রোতে। আগেও দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্বকাপেও অভিজ্ঞ বিসমার হাতেই নেতৃত্বের দায়িত্ব তুলে দিলেন নির্বাচকরা। কিন্তু খেলা তো হবে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে। লম্বা সময় সেখানেই কাটাতে হবে। তার ওপর করোনা আবহ। থাকতে হবে বায়ো-বাবলে। ছমাসের ছোট্ট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এই লম্বা সফরে পাড়ি দেওয়া কি ঠিক হবে! আবার রেখে যাওয়াও মুশকিল। 

ছবি : আইসিসি

দ্বিধার পাহাড় ডিঙিয়ে ঠিক করলেন মেয়েকে নিয়েই যাবেন। বিমান থেকে মেয়েকে নিয়ে নামছেন, সেই ছবিটাও ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রবিবার ভারত—পাক ম্যাচের পর যেটা ঘটল, সেটা সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো। মাঠে নিয়েই এসেছিলেন ছোট্ট ফতিমাকে। ম্যাচের পর মাঠের ধারে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ ছুটে এলেন ভারতীয় ক্রিকেটাররা। একটু আগেই যাদের সঙ্গে লড়াই হল, তাঁরাই কিনা এগিয়ে  এসে আদর করছেন। সেলফি তুলছেন ভারতের মেয়েরা। গায়ে শুধু জার্সির রঙটাই আলাদা। নইলে, মনে হবে বৃহত্তর এক পরিবার। যেন মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু। আর ঘিরে আছেন মাসিরা। 

ভারত— পাক ক্রিকেট মানেই কেমন  একটা যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ। আর বিশ্বকাপ হলে তো কথাই নেই। জিতলেই পাড়ায় পাড়ায় দেশপ্রেমের জোয়ার বয়ে যায়। আর হারলেই শুরু হয়ে যায় মুণ্ডপাত। খোঁজা শুরু হয়ে যায়, কে আসল খলনায়ক। একই ছবি সীমান্তের ওপারেও। সেখানে হয়ত তীব্রতা আরও বেশি। কারণ, ভারতের কাছে হেরে অনেকসময় নিজের দেশেও ফিরতে পারেননি ক্রিকেটাররা। 
খেলার মাঠে বহু বছর ধরেই চলে আসছে এই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু খেলার মাঠ তো শুধু খেলার মাঠের নিয়মে চলে না। অনেকসময় তার চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায় দুই দেশের রাজনীতি। পরিস্থিতি এমনই, এক দেশ আরেক দেশের মাটিতে খেলতেও যায় না। এক দেশের আইপিএলে ব্রাত্য প্রতিবেশী দেশের ক্রিকেটাররা। 

এই যখন আবহ, তখন মেয়েদের বিশ্বকাপের ছবিটা যেন অন্য বার্তা রেখে গেল। ছবিটা নিমেষে ছড়িয়ে গেল। এমনকি আইসিসির টুইটার হ্যান্ডলেও পোস্ট করা হল ছবিটা। লেখা হল, ছোট্ট ফতিমার প্রথম শিক্ষা। এটাই ভারত—পাকিস্তান ক্রিকেটের স্পিরিট। ছোট্ট মেয়ে বোঝে না ভারত কী, পাকিস্তানই বা কী। সে বোঝে না সীমান্ত সমস্যা বা জঙ্গিহানা কাকে বলে। সে এটুকু বুঝল, মা আর মাসিদের মধ্যে কোনও লড়াই নেই। নীল জামা পরা এই মাসিরাও তাকে সত্যিই ভালবাসে।