আতসবাজির অপমৃত্যু

ট্রাম্পার চলে গেছেন জন্মের ৬৭ বছর আগে। ব্র্যাডম্যান খেলা ছেড়েছেন আমি জন্মানোর পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের চার পেসার দেখিনি। লিলি-থমোও না। মায় হ্যাডলি-চ্যাটফিল্ড, সরফরাজ-ইমারানও বাবা-দাদার মুখে শোনা।  আমাদের আক্রম ছিলেন। আর ছিলেন আপনি। নয়ের দশকের গোড়ায় দমদমে ভাড়া বাড়ির আধডোবা পাঁচিলে ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ লেখায় ছিল ড্রেনের পাঁক আর পেচ্ছাপের দাগ। অন্দর নয়, ভিতরের দেওয়ালে শচীন ছিলেন না। যে ছ’জনের ছবি ভাড়া বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো ছিল, তার মধ্যে ছিলেন আপনি। বাকিরা, আজ্জু-ওয়াজ-স্টিভ (ও)-লারা-প্যাটারসন। 

৩৯ বছর বয়সে এসে কৈশোর ও যৌবনের নায়কের সমাধিতে জানাজা পড়তে বড় কষ্ট হয়। তাও আবার এক আতসবাজির অন্নজল দেওয়া।

অস্ট্রেলিয়ায় জন্মে ৭০৮ টি উইকেট, উইজডেনের শতাব্দীসেরা ক্রিকেটার, ডনের নিমন্ত্রণ, একটি একদিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়, একটি রানার্স এ সবই নিছক পরিসংখ্যান। পরিসংখ্যানের প্রতি বিশ্বাস রেখে বা নেভিলীয় ঔদাসীন্যে রোম্যান্টিসাইজ করেও শ্যেন ওয়ার্ন সর্বকালের সেরা স্পিনার তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

চোদ্দটি বছর ধরে ওয়ার্ন রাজত্ব করেছেন ক্রিকেটবিশ্বকে। তর্কপ্রিয় সহনাগরিক গর্জে উঠবেন মুথাইয়া মুরলীধরণের সপক্ষে। কিন্তু মুরলী শ্রীলঙ্কান। হোম সিরিজ এবং ভারত-পাকিস্তানের পিচ পেয়েছেন অনেক বেশী। সেই প্রেক্ষিতে গাব্বা-ওয়াকার দেশে জাত ওয়ার্নের লড়াই কয়েকশো গুণ কঠিন ছিল। 

হেঁটে-হেঁটে ছোট্ট রান আপ, বাঁ হাতের ব্যালেন্সে হাওয়া কেটে ডান হাতে ছোঁড়া জাদু। যে ভানুমতীর মর্মার্থ বোধগম্য হয়নি ব্যাটারদের। আব্দুল কাদিরের অবসরের পর উত্থান ওয়ার্নের। সমসাময়িক লেগস্পিনার হিসাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অনিল কুম্বলে, মুস্তাক আহমেদ, বা স্বদেশীয় স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল। ভারতীয় উপমহাদেশে তৃতীয় দিন চা-বিরতির পর কুম্বলেকে বাদ দিলে ওয়ার্ন অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠতম। 

শুরু থেকেই শুরু করি। ১৯৯২ সালে সিডনি টেস্ট।  আগের দুই টেস্টে পর্যুদস্ত ভারত একটু দাঁত ফোটাতে পেরেছিল সেই টেস্টেই। মন্থরতম দ্বিশতরানের পর রবি শাস্ত্রীকে ফেরান অভিষেক-ঘটা শ্যেন। বাকি তেমন কিছু করতে পারেননি। বাদ পড়লেন।

ভুল বললাম। বলা ভালো আরেকটু ধার বাড়াতে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন ৬ মাস পর অ্যাশেজে। ওল্ড ট্রাফোর্ডে দুই ইনিংসে চারটে করে উইকেট। এবং গ্যাটিং-কে বোল্ড করা সেই বিখ্যাত “বল অফ দ্য সেঞ্চুরী”। জীবনের তৃতীয় টেস্টে এই সাফল্য ছিল ভবিষ্যতকে রাজত্ব করার সশব্দ তোপধ্বনি। পরের টেস্ট লর্ডসেও দুই ইনিংসে চারটি করে উইকেট। গোটা সিরিজে ৩৪ টি উইকেট। ছয় ম্যাচের অ্যাশেজ সিরিজ ৪-১ এ নিজের দেশে নিয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক অ্যালান বর্ডার। নায়ক শ্যেন ওয়ার্ন।

এরপর জাঁকিয়ে বসা। মার্ক টেলর, স্টিভ ওয়, রিকি পন্টিং এমন কি নিজের স্বল্প সময়ের অধিনায়কত্বেও। 

একটু ওয়ান ডে ক্রিকেটে ফিরি। মোহালিতে ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনাল। অস্ট্রেলিয়ার ২০৭ রানের পুঁজি। অন্যদিকে রিচার্ডসন-লারা-চন্দ্রপল-আর্থারটন-অ্যাডামস অলঙ্কৃত ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সপ্তম ওভারে বল করতে এসে প্রথমে ব্রাউনকে নিজের হাতেই জমা নিলেন ওয়ার্ন। তারপর একধারে কার্পণ্য, অন্য হাতে গিবসন, অ্যাডামস, বিশপকেও আউট করে রান সাপ্লাই লাইন অকেজো করে দিলেন। অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে। 

ফাইনালে সমস্যা ছিল শিশির। গদ্দাফিতে টসে জিতে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুনা রণতুঙ্গা প্রথমে ফিল্ড করলেন। শিশির ভেজা পিচে মাত্র ২৪৪ রান ডিভেন্ড করা কার্যত অসম্ভব ছিল অস্ট্রেলিয়ার। তদুপরি  আঙুলের সমস্যায় গুগলি ডেলিভার করতে অসমর্থ ছিলেন ওয়ার্ন। ফলত রূপোর মেডেল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ওয়ার্নকে। 

কিন্তু পরের বার ইংল্যান্ডে? হেডিংলের যে ম্যাচে স্টিভ ও’র ইনিংস গত শতাব্দীর অন্যতম সেরা বলা হয়, সেই ম্যাচে কৃপণতম ছিলেন ওয়ার্ন। তারপর এজবাস্টনে সেমি ফাইনালে টাই-হওয়া শতাব্দী শ্রেষ্ঠ থ্রিলারে নায়ক ছিলেন ওয়ার্ন। দ্বিতীয় চেঞ্জ বোলারে বল করতে এসে ওভালে গ্যারি কার্স্টেন, হার্শেল গিবস, হ্যানসি ক্রোনিয়ে, এবং প্রায় শেষ লগ্নে জাক কালিস কে আউট করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সংযত করা ম্যাচের নায়ক ছিলেন শ্যেন ওয়ার্ন।

ফাইনালেও নায়ক সেই ওয়ার্ন। একা হাতে পাকিস্তানকে মাটি ছোঁয়ালেন তিনি। শেষ দুই ম্যাচে নায়ক হলেন শ্যেন ওয়ার্ন।

টেস্ট ম্যাচের নিরিখে বহু ক্রিকেট-তার্কিক বলে থাকেন শ্যেন ওয়ার্ন ভারতের বিরুদ্ধে সফল নন। ১৯৯৯-২০০০ সালে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফর মনে করুন। অ্যাডিলেডে প্রথম টেস্টে ওয়ার্নের হাতে বধ হলেন রাহুল-শচীন-সৌরভ। সনাতন পাঠক, আপনি ভারতের বাকি লাইন-আপটা দেখে নিন। 

১৯৯৪ সালের অ্যাশেজে গাব্বায় দ্বিতীয় ইনিংসে আট উইকেট, মেলবোর্নে ৬ টি, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লাহোরে তো ইতিহাস। 

কেচ্ছাগুলো এসেছিল। চ্যাম্পিয়ানদেরই মানায়। পাবলো পিকাসো, জঁ জেনে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়েও সমকাল কুৎসা রটিয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেলকে মেরেছে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ানদের খাটো করতে চাইলে তাঁদের গ্রেটনেস আরও বিকশিত হয়। 

ওয়াভার্লের ময়দান এত প্রিয় ছিল? বাউরালের রাস্তায় কেন রবীন্দ্রগানে “এ পথে পড়বে মনে যখন চিনিতে পাবে রজনীগন্ধার গন্ধ ভরেছে মন্দিরে” এত জলদি গাওয়া হবে? আপনি ছাড়া ভারতের ফ্যাব ফোর এত উজ্জ্বল হতেন না। ২০০৩-০৪ সালে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে আপনি ছিলেন না যে!

রাত হয়ে আসছে। কাল সকালে অফিসের কাজ। এবার ঘুম। না ঘুমের ব্যর্থ চেষ্টা? অনন্ত ঘুমে প্রিয় ক্রিকেটার – বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। ক্রিকেটের শেষ ১৪০ বছরের ইতিহাসে যদি একটিও দল গঠন করতে হয়, ভিক্টর ট্রাম্পার, ডোনাল্ড ব্রাডম্যানের সাথে থাকবেন শেন ওয়ার্ন। এস.সি.জি-র পাশে ওয়াভার্লে কবরে ট্রাম্পারের পাশেই হয়ত চিরনিদ্রায় থাকবেন আতসবাজি। হয়ত ট্রাম্পার এবং ব্র্যাডম্যান বলছেন, “ওয়ার্নি, তুমি পথশ্রমে ক্লান্ত, বিশ্রাম  নাও। তারপর বল করো। স্বর্গের পিচ শক্ত হয়, ফাটে, আবার ১৯০২-এর বিলেতের মতো আঠালোও হয়। বল করো, তোমার বিরুদ্ধে ব্যাট করে আমরা ভাগ্যবান হই।”