এ যেন অনেকটা পরপর দু’বলে দুই উইকেটের পতন। সকালবেলা ঘুম ভেঙেছিল ডাকাবুকো এক উইকেট রক্ষকের (রডনি মার্শ) প্রয়াণের খবর শুনে। সন্ধেয় এল এক পাগলকরা ইয়র্কার ডেলিভারি। শেন ওয়ার্ন প্রয়াত। হজম করা কঠিন। আজকালের কাছ থেকে খবর শুনে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আমি এই খবর মানি না। ইয়ে সব ক্যায়া হো রহা হ্যায়? মাত্র ৫২ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাক!’
হ্যাঁ, বিশ্বাস করতে চাইনি। কারণ খবরটা এসেছিল থাইল্যান্ড থেকে। পরিবারের পক্ষ থেকে একটা ছোট অনুরোধ ছিল, ‘একটু প্রাইভেসি মেইনটেন করুন।’ দুঃসংবাদ শোনার পর আজকাল ক্রীড়া দপ্তরে টেলিফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, এরকম কোনও খবর পৌঁছেছে কিনা। তখনও কোনও খবর পৌঁছয়নি। তা হলে হয়তো ভুল খবরই এসেছে। কিন্তু অচিরেই সুনীল গাভাসকার জানালেন, ‘মর্মান্তিক। তবে খবরটা ঠিক।’ প্রশ্ন হল, দুনিয়ার সেরা লেগ স্পিনার থাইল্যান্ডে কী করছিলেন? পরে জানা গেল, ওদেশে কো সামুই অঞ্চলে যখন চিকিৎসকরা তাঁর শরীর পরীক্ষা করছিলেন, ততক্ষণে তিনি আর ইহলোকে ছিলেন না। শুধুই কি হার্ট অ্যাটাক? অসংযমী জীবন–যাপন করতেন বুক ফুলিয়ে। এসব কারণেই কি হারিয়ে গেলেন চিরতরে?
শেষ দেখা হয়েছিল, স্টার স্পোর্টসের কমেন্ট্রির ফ্লোরে। সারাক্ষণই ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতেন বলে দেখা হলেই বলতেন, ‘আমি কিন্তু এখনও জায়গায় বল রাখতে পারি।’ সত্যিই বিশ্বাস করি, মাঝরাতেও তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে যদি হাতে একটা বল ধরানো হত, তিনি প্রথাসিদ্ধ লেগ স্পিন বোলিং ঠিক জায়গায় রাখতে পারতেন। আবদুল কাদিরের কাছে শুরুর দিকে কিছুটা তালিম নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু কখনও নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য গুগলির ব্যবহার করতে চাইতেন না। টার্ন করা বলতে যা বোঝায়, বিশাল তালু থেকে বল ছাড়তেন শুধুমাত্র লেগ স্পিন বোলিং করার জন্য। ওইরকম ডেলিভারি থেকেই ’৯৩–এ লর্ডসে রাউন্ড দ্য লেগ বোল্ড করে দিয়েছিলেন মাইক গ্যাটিংকে। যা দেখে ধারাভাষ্য দিতে দিতে রিচি বেনোর মতো ধারাভাষ্যকার বলে উঠেছিলেন, ‘বল অফ দ্য সেঞ্চুরি!’
অস্ট্রেলিয়ার কোচ ববি সিম্পসন তাঁকে বলেছিলেন, গুগলি করতে না চাইলে বল কিন্তু জায়গায় রাখতে হবে। তার জন্য চাই নিরন্তর অনুশীলন। বাধ্য ছাত্রের মতো ওয়ার্ন কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেটে বোলিং করে যেতেন। নিজের চোখে দেখেছি। ৪৬ ডিগ্রি গরমে স্টিভ ওয়া যখন দল নিয়ে মাঠ ছেড়ে হোটেলে ফিরে গিয়েছিলেন, তখন একটি রুমাল রেখে শেন একা একা বোলিং করে যাচ্ছেন। এই যাঁর অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, তাঁকে আটকাবে কে? নাহ্, কেউ তাঁকে আটকাতে পারেনি। মুথাইয়া মুরলিথরন হয়তো ৮০০ উইকেট পেয়েছেন (বিষাণ সিং বেদি যাঁকে জ্যাভলিন থ্রোয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন)। জাদুকর ওয়ার্ন সম্পর্কে এমন কোনও অভিযোগ কিন্তু আনতে পারেননি কোনও সমালোচক।
ওজন অনেকটাই বেশি ছিল শুরুর দিকে। অনেকেরই মনে থাকবে, রবি শাস্ত্রী তাঁকে তুলোধোনা করেছিলেন প্রথম সিরিজের সময়। তারপর সময় যত এগিয়েছে ওয়ার্নের লেগ স্পিনের ফাঁদে ধরা পড়েছেন অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান (প্লিজ শচীন তেন্ডুলকারকে এই তালিকায় ফেলবেন না)।
যাওয়ার কথা ছিল নাগপুর। কাকভোরের ফ্লাইট। মুম্বই টু নাগপুর। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি বিশাল জটলা তাঁর পাশে। পকেট থেকে পয়সা বের করে বিভিন্ন পজিশনে ফিল্ডিং ছড়িয়ে ইয়ান চ্যাপেল তাঁকে বোঝাচ্ছিলেন, ‘রাউন্ড দ্য উইকেট বোলিং করার সময় ডিপ পয়েন্ট রাখা মানে তোমাকে আর অ্যাটাকিং স্পিন বোলার বলা যাবে না। অ্যাটাক করবে যখন, ব্যাটসম্যানকে প্রলুব্ধ করার জন্য ফাঁকা জায়গা দাও। স্পিনে বিট করো।’ ইয়ান চ্যাপেল কোনওদিন ওয়ার্নের বোলিংয়ে খুঁত খুঁজে পাননি। সদ্য প্রয়াত সুরজিৎ সেনগুপ্ত যেমন সাতটা খুন করে এলেও দিয়েগো মারাদোনার খেলায় যেমন খুঁত খুঁজে পেতেন না। দু’বছর আগে হ্যামশায়ার ক্রিকেট মাঠে হঠাৎই দেখি, নিজের নামের স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। ‘এই মাঠে এলে ছাতি ৫৬ ইঞ্চি হয়ে যায়। গর্ডন গ্রিনিচ, ব্যারি রিচার্ডস, ম্যালকম মার্শালদের কাউন্টিতে খেলেছি বলে শুধু নয়, একজন অস্ট্রেলীয়কে একটা আস্ত স্ট্যান্ড দিয়ে দিল ইংরেজরা, এটা ভেবেও কি গর্ব বোধ হবে না?’
একের পর এক নানা মুহূর্তের স্মৃতি ধেয়ে আসছে। নিশ্চিত, যতই উল্টো মেরুতে থাকুন না কেন স্টিভ ওয়া, জন বুকাননদেরও মুখ থেকে কথা সরছে না। আজ, এই ফাগুনের সন্ধ্যার সব রং যেন নিয়ে গেলেন ক্রিকেটের বর্ণময় এই চরিত্র। একইসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে, মেলবোর্ন মাঠের জাদুঘরে লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের অসাধারণ প্রযুক্তিতে শেন ওয়ার্ন ঢুকছেন, আবার যাবতীয় কাজ সেরে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর গুণমুগ্ধরা মনে করছেন, এভাবেই যেন তিনি আবার ধরাধামে ফিরে আসেন। পপ ইন, পপ আউট— লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান আপনাদের সবার সামনে হাজির শেন ওয়ার্ন।