‘মাথার ওপরে পা তুলেও কী করে দাঁড়িয়েছিলে? ব্যালান্স হারাওনি!’
সবিস্ময় প্রশ্ন ছিল ভিভিয়ান রিচার্ডসের। সতীর্থ মাইকেল হোল্ডিং-এর জন্য। প্রশ্নের কারণ সেই ছবিটা। নিউজিল্যান্ডের ডুনেডিনে ১৯৮০ সালের ঘটনা। ব্যাটসম্যান জন পার্কার আউট হয়েছেন ভেবে গ্লাভস খুলে ব্যাট বগলে নিয়ে ফেলেছিলেন। কিউই পাখির দেশের আম্পায়ার তবুও আউট দেননি!
ক্রোধান্ধ হোল্ডিং সজোরে স্টাম্পে লাথি মেরেছিলেন। দুটো স্টাম্প গড়াগড়ি খেতে চলেছে, ছবিতে পরিষ্কার। ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে কালীপুজোর দিন সন্ধেবেলা ক্রিকেটলিখিয়ে দেবাশিস দত্তর টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে চাঁদের হাট। ভিভ আর মাইকি আসবেন, থাকবেন গোপাল বসুও। এমন আসরে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দেবাশিসদার, ‘তুই আসবি’। কি করেই বা অস্বীকার করি!
এত কাছে এমন দুজনকে পাব, খালি হাতে কি করেই বা যাই। দুটো ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম, সই নিতে। যার একটিতে হোল্ডিং-এর এই ভঙ্গি। আর তা দেখেই রিচার্ডসের সেই প্রশ্ন।
কিন্তু, হঠাৎ এই ছবির কাছে ফেরা কেন?
কারণ, কোভিড-আবৃত জীবনে ক্রিকেট থেকে দেশ-নিরপেক্ষ আম্পায়ারের বাধ্যতামূলক উপস্থিতি বিলুপ্ত। ফিরে যাওয়া আবার সেই দিনগুলোয় যখন দেশের খেলায় দেশের আম্পায়াররাই থাকতেন। কিন্তু আর শুনতে হচ্ছে না শ্বেতাঙ্গ-বিদ্রুপ।
চালু হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ৭ই নভেম্বর। যাঁর মস্তিষ্কের কারণে তাঁর ক্রিকেটজগতে নামডাকের পাশাপাশি হাঁকডাকও ছিল। ইমরান খান। পাকিস্তানের অধিনায়ক চেয়েছিলেন তাঁর দেশে এসে হেরে গিয়ে যেন শকুর রানাদের বিদ্রুপ না করে সফরকারী দল। তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দেশের মাঠে লাহোরে সিরিজের দ্বিতীয় (ও করাচিতে তৃতীয়) টেস্টে আম্পায়ারিং করতে ডেকেছিলেন দুই ভারতীয় পিলু রিপোর্টার এবং ভিকে রামস্বামীকে।
ইমরান তাঁদের বলেছিলেন ‘থার্ড-কান্ট্রি’ আম্পায়ার। যে দুই দেশ সিরিজে মুখোমুখি তার বাইরের তৃতীয় দেশের আম্পায়ার। উদ্দেশ্য একটাই — দেখিয়ে দেওয়া, নিজেদের অপারগতার কারণেই হেরেছে শ্বেতাঙ্গরা, দেশের আম্পায়ারদের দিয়ে হারানো হয়নি।
অদ্ভুত এই প্রচার প্রচলিত ছিল, এখনও বিরাটভাবেই আছে, নিঃসন্দেহ। আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য শকুর রানা, আর শ্বেতাঙ্গ আম্পায়াররা যাঁরা শচীন তেন্ডুলকারকে ‘ব্যাক-বিফোর-উইকেট’ বা বিবিডব্লু দিতেন, মুথাইয়া মুরলিথরনকে ‘নো’ ডাকতেন, নিউজিল্যান্ডে এক ম্যাচে রিচার্ড হ্যাডলিদের দু-ইনিংস মিলিয়ে গোটা বারো-চোদ্দ এলবিডব্লু দিতেন বা ভাগবৎ চন্দ্রশেখরের মতো শান্তশিষ্ট বোলারও ব্যাটারকে বোল্ড করে আম্পায়ারকে চিৎকার করে ‘হাউজ দ্যাট’ প্রশ্ন করতে বাধ্য করাতেন, তাঁরা সবাই ধোয়া তুলসীপাতা!
হোল্ডিং সম্প্রতি তাঁর শ্রেষ্ঠ বইটি লিখেছিলেন ‘হোয়াই উই নীল, হাউ উই রাইজ’। হ্যাশট্যাগযুক্ত ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘যে-ইতিহাস আমরা পড়ি বা পড়ানো হয়, সেটা শ্বেতাঙ্গদের লেখা। তাই সেই ইতিহাস ঠিক করা আগে জরুরি। ঠিকটা না জানলে ভুলটাকে চিনতে শিখব কী করে?’
এই শ্বেত-চালাকি শেষ করার উপায় খুঁজেছিলেন ইমরান। সে জন্যই তাঁকে অকথা-কুকথা শুনতে হয়েছিল। প্রধানত শ্বেতাঙ্গদের ছড়ানো প্রচার থেকেই যে, ‘ভারত-পাকিস্তানে তো খেলবে আম্পায়াররাই, তেরজনের বিরুদ্ধে খেলা’! ক্রিকেটে তেরজন, ফুটবলে বারো বা চোদ্দজন, এই সংখ্যাগুলোর সৃষ্টিকর্তা সেই শ্বেতাঙ্গ-সমাজ, আমরা যাদের দেখলেই বিগলিত হয়ে ফরসা শ্রীচরণে প্রাণদান করতে সাষ্টাঙ্গ প্রণামে উদ্যত হই, ময়দানি ভাষায় বলতে গেলে ‘ল্যা-ল্যা’ করি। তাই ক্রিকেটভক্ত হলেই শ্বেতাঙ্গ এবং ইংরেজি ভাষাপ্রীতির পতাকা ভাসাই আকাশে, আরও উঁচুতে তুলে ধরার চেষ্টায় কে কত এগিয়ে বোঝাতে সচেষ্ট।
ইমরানের পর থেকে আস্তে আস্তে নিয়ম বদলেছিল, রীতি হয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটে। কোনও হোম সিরিজে আর স্বাগতিক দেশের আম্পায়াররা ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পেতেন না।
কোভিড আমলে সেই ধারায় আপাতত দাঁড়ি। জৈব বলয়, দেশের আম্পায়ারদের দিয়ে কাজ চালাতেই হবে, বাধ্যতা। তার চেয়েও বড়, ক্রিকেটে প্রযুক্তির ব্যবহার। স্নিকো আছে, বলের গতিপথ দেখানোর ক্যামেরা আছে। টিভি-আম্পায়ারের উপস্থিতিতে ভুল সিদ্ধান্তের জায়গা নেই-ই প্রায়। তা হলে আর দেশ-নিরপেক্ষ আম্পায়ারের উপযোগিতা কী?
ভারতের খেলায় মাঠে দাঁড়াতে আর কোনও বাধা নেই এখন নীতিন মেননের। কোভিড আর ক্যামেরা প্রযুক্তি তাঁর বিরাট সহায়। শ্বেতাঙ্গদের অযথা বিদ্বেষমূলক অভিযোগের শিকার হতে হবে না আর, নিজের দেশের ম্যাচেই আম্পায়ারিং করতে গিয়ে।
কবরে এখন তাই শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন শকুর রানা, ২০০১ সালে প্রয়াত হওয়ায় যিনি এই দিনগুলো জীবিতাবস্থায় দেখে যেতে পারেননি।