উপহারের ২২ বছর এবং সাইমন্ডস

ক্রিকেট অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের পেশা ছিল ঠিকই। তবে ছোট থেকেই নেশা একটাই। যাবতীয় ঝুঁকি উপেক্ষা করে মাছ ধরতে যাওয়া। এই নেশার কারণেই পেশায় সময়ের বহু আগে থামতে হয়েছিল দুর্ধর্ষ অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডারকে। সে নিয়ে অনুতাপে যে নিজেকে ঘেন্না করেছেন, এমনও কিন্তু নয়। বরং ক্রিকেট জীবন শেষ হয়েছিল যে মাছ ধরার নেশায়, তাকেই আঁকড়েছেন বাকি জীবন জুড়ে।

হার্ভি রেঞ্জের দুর্ঘটনার মতো সেদিনও এক শনিবার ছিল। সালটা ২০০৮। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরেরদিন প্রথম ম্যাচ খেলতে অস্ট্রেলিয়া নামবে ডারউইনে। অথচ, দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে উপস্থিত থাকলেন না সাইমন্ডস। হাজিরার সম্ভাবনাও ছিল না। কারণ, যখন এই বৈঠক হবে বলে স্থির হয়, তার বহু আগেই সাইমন্ডস বেরিয়ে পড়েছিলেন বোট জোগাড় করে। ওইদিনই পরের দিকে ঐচ্ছিক অনুশীলন ছিল অস্ট্রেলিয়ার। তা আগেই যাবেন না বলে মনোস্থির করেছিলেন অসি ক্রিকেটের ‘রয়’।

এবার জল বহুদূর গড়াল। তাঁর চূড়ান্ত অপেশাদারিত্ব ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে এতটাই হতাশ করেছিল যে, অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন কোচ টিম নিয়েলসন, অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক ও সিরিজের বাইরে থাকা রিকি পন্টিং সমন্বিত লিডারশিপ গ্রুপ সাইমন্ডসকে ব্রিসবেনে তাঁর বাড়িতে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এক মাস সময় দেওয়া হয় অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট নিয়ে নিজের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করার। 

এমন ঘটনা আগেও, ২০০৫ সালে ঘটিয়েছেন সাইমন্ডস। সেবার কার্ডিফে এমন মত্ত অবস্থায় মাঠে এলেন যে, তাঁকে খেলার অনুমতি দেয়নি অস্ট্রেলিয়ান টিম ম্যানেজমেন্ট। বন্ধু মাইকেল ক্লার্ক তাঁর আইপিএলের মোটা অঙ্কের চুক্তির পর থেকে সাইমন্ডসকে ঈর্ষা করতেন বলে দাবি করেছিলেন সদ্য প্রয়াত ক্রিকেটার। সেই থেকেই নাকি দূরত্ব। যার পরিণাম ছিল, ২০০৮-এর ‘ঘর ওয়াপসি’। ওই বছরের কুখ্যাত ‘মাঙ্কিগেট’ অসি ক্রিকেটারের শেষের শুরু বলে মনে করতেন সতীর্থরা। পরের বছর শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ইংল্যান্ডে টি২০ বিশ্বকাপ থেকেও ফেরানো হল সাইমন্ডসকে। বিতর্ক তাঁর জীবনের অনেকটা আকাশ জুড়ে থেকেছে। এবং বিতর্কে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট কেরিয়ারের অপমৃত্যু ঘটেছে। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর আর কখনও অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে তোলার সুযোগ আসেনি। বেশ কিছু ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচে অংশ নিয়েছেন ঠিকই। ২০১২-তে সমস্ত রকম ক্রিকেট থেকেই সরে যান সাইমন্ডস। অগুনতি বিতর্কের মাঝেও তাঁর ক্রিকেটীয় প্রাপ্তি ছাপিয়ে যায় সমস্ত কালো অধ্যায়কে। নিজের সেরা সময়ে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস বিপক্ষের কাছে এক ত্রাসের নাম। অনবরত যাঁর রক্তে বইত আগ্রাসন।  অথচ ক্রিকেট থেকে যা কিছু পেয়েছেন, এ সবের অনেক কিছুই তাঁর পাওয়া হত না। ২২টা বছর উপহার পেয়েছেন জীবন। ২০০০ সালেই নিশ্চিত মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে ফিরেছিলেন। মাছ ধরার নেশাই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল সাইমন্ডসকে। সেবার অবশ্য তিনি একা ছিলেন না। সঙ্গে ছিলেন আরেক অস্ট্রেলীয় প্রাক্তন তারকা ম্যাথিউ হেডেন।

সাইমন্ডসের আত্মজীবনী ‘রয়’-এর সহ লেখক স্টিফেন গ্রে একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সাইমন্ডস, হেডেন এবং তাঁদের এক বন্ধু মাছ ধরতে বেরিয়েছিলেন বোট নিয়ে। বোট জলে রেখেই সাঁতার কাটতে নেমেছিলেন তিনজন। হঠাৎ চোখের সামনে বোটটি ডুবে যায়। আশেপাশে কোনও কিনারা নেই। অনেকটা পথ সাঁতরে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা চালাবেন ওঁরা। কিন্তু যে জায়গা দিয়ে তীর খোঁজার চেষ্টা করবেন সাঁতরে, তা হাঙরদের স্বর্গরাজ্য। তাদের আনাগোনা হামেশাই। সাঁতরানো ছাড়া দ্বিতীয় পথও খোলা ছিল না। ছোট থেকে সাইমন্ডস বেড়ে উঠেছেন কুইন্সল্যান্ডের যে অঞ্চলে, অধিকাংশ মানুষজন অবসর যাপন করেন মাছ ধরে এবং সাঁতার কেটে। হেডেনও দুরন্ত সাঁতারু। তবে তিন ঘণ্টা এক নাগাড়ে সাঁতার কাটা তো আর চারটিখানি কথা নয়! তাও আবার হাঙর-বলয়ে। হেডেনদের বন্ধু প্রথম মিনিট বিশেক অলিম্পিকে পদক পাওয়ার মতো সাঁতরালেন। তারপরই জানালেন, ‘আমি আর পারছি না।’ হেডেন এবং সাইমন্ডস তাঁদের বন্ধুকে বোঝান, এটা পারা না পারার কোনও বিষয় নয়। এখানে না পারার অর্থ মৃত্যু। বন্ধুকে সেদিন দীর্ঘ সময় সাঁতার কাটার কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিন ঘণ্টা পর একটা দ্বীপে উঠেছিলেন। সে যাত্রায় হাঙর ভাগ্যক্রমে ছোঁয়নি সাইমন্ডসদের। কিন্তু ২২ বছর পর মৃত্যু ছুঁল তাঁদেরই একজনকে।