রেঞ্জর্স মাঠে বিগত মরশুমের সিএবি প্রথম ডিভিশন লিগের ম্যাচ চলছে মহামেডান এবং নেতাজী সুভাষ ইনস্টিটিউটের মধ্যে। নেতাজী দলের যুবা ব্যাটার ইমন দত্ত শুরু থেকেই বেশ ছন্দে এবং একটি ভালো বাউন্ডারিও মেরে দিয়েছেন ততক্ষণে। হঠাৎ এক বাঁহাতি স্পিনারের ওভার দ্য উইকেট আসা বল পিচ করল গুড লেংথে। আদর্শ সুইপ শট খেলার বল এবং ইমন তাই চেষ্টা করেছেন কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করলেন বল তার প্যাড ছুঁয়ে গিয়েছে এবং নিজের আঙ্গুল তুলতে লেশমাত্র দেরি করেননি আম্পায়ার। ইমন যখন ফিরছেন হেলমেট হাতে নিয়ে তখন নেতাজী দলের সিনিয়র খেলোয়াড় অরিজিৎ ব্যানার্জী বললেন “ভাই সামলে! ওটা সৌম্য পাকড়ে! রাহুল দ্রাবিড়কে আউট করেছিল।”
একদিন বিকেলে হোয়াটস্যাপ মারফত জিজ্ঞেস করি সৌম্য পাকড়েকেই জিজ্ঞেস করি যে তিনি প্র্যাক্টিসে আউট করেছিলেন কিনা দ্রাবিড়কে। উত্তরে পাকড়ে বলেন ” না রে। ওটা বিজয় হাজারে সেমিফাইনাল ছিল। ” সৌম্য সেদিন বলেননি যে ওটাই তার বাংলার হয়ে অভিষেক ম্যাচ ছিল এবং সেই অভিষেক ম্যাচে বরোদার মতিবাগ স্টেডিয়ামে কর্ণাটকের যে ব্যাটিং তিনি সামলে পেয়েছিলেন তা হলো রবিন উথাপ্পা, মনীশ পান্ডে, রাজু ভাটকল, অমিত ভার্মা, চিদাম্বরম গৌতম এবং স্বয়ং রাহুল শরদ দ্রাবিড় সম্বলিত। সেই ম্যাচে রাহুল দ্রাবিড় যখন তার বল খোঁচা দেন তখন তার নামের পাশে লেখা হয় – রাহুল দ্রাবিড় কট ঋদ্ধিমান সাহা বোল্ড সৌম্য লক্ষীনারায়ণ পাকড়ে ২৯(৪৮)। বিনয় কুমারের উইকেট এর সঙ্গে যুক্ত হলে তার বোলিং ফিগার দাঁড়ায় ১০-০-৩৪-২ এবং ইকোনমির বিচারে শুধু সৌরাশিষ লাহিড়ী ছিলেন তার থেকে এগিয়ে।
১৪ বছর বয়স থেকে বাংলা দলের সদস্য সৌম্য। প্রথম বছর অর্থাৎ ২০০৩-০৪ পলি উমরিগর ট্রফিতে ৯.৩৬ গড়ে ৩২টি উইকেট নিয়ে তিনি ছিলেন চন্দন গোস্বামীর পরে বাংলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। এরপরে অনুর্ধ-১৭ স্তরে তিনি বিজয় মার্চেন্ট ট্রফি খেলেন সেখানেও ৯.২৫ গড়ে তোলেন ২০টি উইকেট এবং বাবলু গোস্বামীর পর ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। পরের বছরও বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে তিনি ছিলেন বাংলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। ১৮টি উইকেট ১৭.০৫ গড়ে নিয়ে তিনি ছিলেন রঞ্জিত প্রসাদের ঠিক পিছনে। তার পরের বছর অনুর্ধ-১৯ স্তরে বিনু মানকড় ট্রফিতে বাংলার হয়ে ১১.৬৪ গড়ে ১৪ উইকেট নেন তিনি এবং ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। ঠিক এরপরের বছরেই আবার বাংলার যুগ্ম সর্বোচ্চ উইকেটশিকারীর নাম সৌম্য পাকড়ে। এবার ১০টি উইকেট নিয়ে আজাজ আনসারীর সঙ্গে যুগ্ম শীর্ষে সৌম্য। পরের বছর কোচবিহার ট্রফিতে একটু ঘাটতি হয় ফর্মে এবং ১৭টি উইকেট নিলেও তার গড় দাঁড়ায় ৩৭! এরপরে পূর্ণাঙ্গ বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট তিনি খেলেন ২০১০-১১ সালের সি. কে নাইডু ট্রফি এবং সেখানেও ১৬ উইকেট নিয়ে তিনি ছিলেন বাংলার সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী।
বাংলার হয়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে সব মিলিয়ে মোট ১৩০টি উইকেট তুলেছেন হুগলী জেলার ত্রিবেণীর ছেলে সৌম্য পাকড়ে এবং দীর্ঘদিন খেলেছেন কলকাতার বড়ো ক্লাবেও। এতো সত্ত্বেও তার লিস্ট এ কেরিয়ারে মাত্র দুটি ম্যাচ এবং নেই কোনো রঞ্জি ট্রফি বা সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফির ম্যাচও। প্রত্যক্ষ ভুল হয়তো হয়েছিল একটাই। নিজের দ্বিতীয় লিস্ট এ ম্যাচ অর্থাৎ বিজয় হাজারে ট্রফির ফাইনালে তারকাখচিত তামিলনাড়ু দলের বিরুদ্ধে প্রবল মার খেয়ে যাওয়া। সেইদিন ৮ ওভার বল করে মোট ৭৫ রান খরচ করে বসেছিলেন সৌম্য। সামনে ছিলেন মুরলী বিজয়, অনিরুদ্ধ শ্রীকান্ত, অভিনব মুকুন্দ এবং দীনেশ কার্তিক। সেদিনের সেই হাই স্কোরিং ম্যাচ যেখানে দুই দল মিলিয়ে ৭৩০ রান তুলেছিল সেইখানে নবাগত স্পিনারের মার খাওয়া স্বাভাবিক ধরাই যেত, কিন্তু কোনো কারণে তা ধরা হয়নি এবং মাত্র কুড়ি বছর দশ মাস বয়সেই লিস্ট এ কেরিয়ার শেষ হয় এক প্রতিভাশালী স্পিনারের।
আজ সৌম্য পাকড়ে ৩২ এর একটু বেশী। মহামেডান মাঠে এখনও বল করেন, মেট্রো রেল দলের হয়ে ইন্টার রেল টুর্নামেন্টে গিয়ে তাদের টুর্নামেন্ট জিতিয়ে আসেন। আসলে সৌম্যরা খেলেন খেলার আনন্দে। ভালো বলে উইকেট নেওয়ার আনন্দ যে পিছনে ফেলে দেয় সবকিছুকেই।