২০০৯ সাল- গোয়ার বিরুদ্ধে প্লেট গ্রুপের সেমিফাইনাল ম্যাচ খেলছে বাংলা। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে অভীক চৌধুরী আউট হওয়ার পরে বেশ ভালো ছন্দে টানছেন ওপেনার অনুষ্টুপ মজুমদার এবং ঋদ্ধিমান সাহা। প্রায় একশো রানের কাছাকাছি পার্টনারশীপ তারা করে ফেলার পরেই হয় ছন্দপতন। ১০১-১ অবস্থা থেকে ১০৫-৪ হয়ে যায় বাংলা। ঠিক এরপরে লক্ষীরতন শুক্লাকে হারিয়ে ১২৭-৫। ক্রিজে তখন দাঁড়িয়ে আছেন সৌরভ গাঙ্গুলি। তার সঙ্গে ব্যাট করতে এলেন এক নবাগত খেলোয়াড় যার প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ অভিজ্ঞতা তখন মাত্র ১। উল্টোদিকে সৌরভ গাঙ্গুলি বলেছিলেন “যতোটা পারিস উইকেটে থাক।” এরপরেই বাংলার রান বাড়তে থাকলো বেশ স্টেডিভাবে। সৌরভ গাঙ্গুলি করলেন ১৪৯ বলে ৬৯। উল্টোদিকে থাকা সেই হাওড়ার ছেলেটার ব্যাট থেকে এলো ৮২ যা সেই ম্যাচে কোনো প্লেয়ারের করা সর্বোচ্চ। বাংলা গোয়াকে পরাস্ত করে ১০৭ রানে। তবে এখানেই থেমে যাওয়া নয়। দ্বিতীয় ইনিংসেও ৪৯ রানের ইনিংস খেলেন দিব্যেন্দু চক্রবর্তী।
দিব্যেন্দু চক্রবর্তী বরাবরই এরকম। তার প্রাক্তন সতীর্থ অম্বরীশ মিত্র মনে করিয়ে দেন প্রায় তেরো বছর আগের একটি ঘটনা। কোয়ার্টার ফাইনালে দিব্যেন্দু-অম্বরীশের নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট মুখোমুখি হয়েছে ইস্টবেঙ্গল দলের। ইস্টবেঙ্গল তখন রনজি ট্রফি খেলা খেলোয়াড়ে পরিপূর্ণ। ২৩ বছর বয়সী অলরাউন্ডার অম্বরীশ মিত্রকে তখন এক জায়গায় ডেকে দিব্যেন্দু চক্রবর্তী বলেন “কাল জেতাতে পারলে তুই স্টার হয়ে যাবি। আমি জানি তুইই পারবি।” পরেরদিন অম্বরীশ মাঠে যান এবং ছয়টি উইকেট তুলে সেমিফাইনালে তোলেন নেতাজি দলকে। মাত্র ২৩৬ রান পুঁজি নিয়েও কিভাবে সম্ভব করলেন? ময়দানের বাকাদা বলেন “দলকে শুধু সেইদিন বলেছিলাম যে যদি এগারোজন মিলে খেলতে পারি তবে ইস্টবেঙ্গলও হারতে পারে আমাদের কাছে। এইটুকুই।”
রনজি ট্রফিতে তার অভিষেক হয় উমেশ যাদব-ফয়জ ফজল-অক্ষয় ওয়াখারের বিদর্ভ দলের সামনে। বিদর্ভের তোলা ৪০৩ রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ২১ ওভারের মধ্যে ১০৭-৪ হয়ে যায় বাংলা। তখন তিন নম্বর ব্যাটার ঋদ্ধিমান সাহাকে সঙ্গ দিতে আসেন অভিষেককারী দিব্যেন্দু। সেইদিন ঋদ্ধিমানের সঙ্গে ৩৭ ওভার ব্যাট করে ১২০ রানের পার্টনারশীপ করেন। উমেশ যাদবের বল উইকেটের সামনে তার পায়ে আছড়ে পড়ার আগে ১৩৩ বল খেলে করেন ৫৬ রান। পরবর্তীতে অভীক চৌধুরীর ধৈর্যশীল ৪৯, ঋতম কুন্ডুর ১১৫ বলে করা ৪৯ সেদিন বাংলাকে লিড দেয়, সঙ্গে তো ১৫৯ রান করে ছিলেন ঋদ্ধিমান সাহা। অভিষেকেই এতো বড় দায়িত্ব নিয়ে কি বলবেন? দিব্যেন্দু বলেন “তখন আমি আর ঋদ্ধিমান চেয়েছিলাম ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং রান বাড়াতে। অভিষেকে এতো বড় ইনিংস খেলতে পারা অবশ্যই ভালো লাগে।”
২০১২-১৩ সালে রেল দল ছেড়ে ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করতে ঢোকেন দিব্যেন্দু চক্রবর্তী। যখন এজি ইন্ডিয়া দলের বিরুদ্ধে খেলছেন সেই বছর হটাৎ বুঝতে পারলেন যে তিনি দৌড়োনোর পড়ে আর নিজের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছেননা। কিছুদিন পরে ডাক্তার দেখানোর পর ধরা পরে তার হার্টের ভাল্ভে রয়েছে ছিদ্র। ঠিক একমাসের মধ্যেই হয় তার অপারেশন।। দিব্যেন্দু বলেন “সেই সময় খুব কঠিন ছিল।৭-৮ ঘন্টা ওপেন হার্ট সার্জারির পরে আর ফিরতে পারবো কিনা জানতাম না।” কিন্ত তিনি ফিরেছিলেন এবং পরের বছর ৯০০ রান করেন এবং বাংলা দলের প্রথম তিরিশে ফেরেন এবং বাংলার একাদশের হয়ে বাংলাদেশে খেলতে যান।
হাওড়ার শিবাজী সংঘ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলা শুরু করেন দিব্যেন্দু। সেইখান থেকে বাংলার সমস্ত বয়সভিত্তিক খেলা খেলার পরে চাকরি পান রেলে। রেল দলের হয়ে সঞ্জীব সান্যালের সঙ্গে এবং সঞ্জয় বাঙ্গারের অধিনায়কত্বে খেলেছিলেন ইন্টার স্টেট্ টিটোয়েন্টি ট্রফি। কিন্ত বাংলা দলের হয়ে তার রনজি ট্রফি খেলার সংখ্যা মাত্র ১০। তার একটি কারণ হিসেবে ধরা যায় যে একজন মিডল অর্ডার ব্যাটারকে তিন নম্বরে পাঠানো। যদিও নিজের কেরিয়ারের শেষ দুটি ম্যাচে অনেক বেশী বল খেলে দ্রুত উইকেট হারানোর ফাঁড়া সামলেছিলেন দিব্যেন্দু। সৌরাষ্ট্র দলের বিরুদ্ধে ২১৪ বল খেলে ৮১ রান করেন তিনি। কতোটা সমস্যার ছিল? দিব্যেন্দু বললেন “বাংলার হয়ে ১-১১ যেখানেই খেলি সেটাই গর্বের। তাই আমি এসব নিয়ে ভাবিনি বরং চেষ্টা করে গিয়েছি যাতে দলের হয়ে কান্ট্রিবিউট করা যায়।”
বর্তমানে আনন্দবাজার ক্লাবের হয়ে খেলছেন দিব্যেন্দু। শেষ তিন মরশুম এই দলেই খেলেছেন একাধিক বড়ো দলের হয়ে খেলা খেলোয়াড়। শেষ মরশুমে সেঞ্চুরিসহ করেছেন ৪৫০ রান। ময়দানের পরিচিত মুখ বাকাদা এভাবেই এগিয়ে যান এটাই তো দেখতে চায় সবাই।