ব্র্যাডম্যানের পড়শিরা -তৃতীয় পর্ব

এখানে একটা হালকা আভাস পাওয়া যাবে কেন জর্জ হেডলিকে সমকালে বলা হত ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’। ১৯২৯-৩০ থেকে ১৯৫৩-৫৪ অবধি বিস্তৃত দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনের অজস্র চড়াই উতরাইয়ের পরও স্বয়ং ডন ও বিজয় মার্চেন্ট (৭১.৬৪) ব্যতিরেকে এই জামাইকানের চাইতে বেশি গড়ে আজ অবধি ময়দান ছাড়তে পারেননি অন্তত পঞ্চাশ ফার্স্ট ক্লাস ইনিংসে ব্যাট করা বিশ্বের আর কোনও ব্যাটারই। যদিও প্রথম শ্রেণির গড়ের ভিত্তিতে মূল্যায়ন আরও বিস্তৃত পরিসর দাবি করে বলেই এই নিবন্ধে আর বেশি কথা বলছি না উক্ত বিষয়ে। যুগের ফারাকই স্রেফ নয়, এক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হয় দেশভেদে ঘরোয়া ক্রিকেটের মানের ফারাকের অনুষঙ্গটুকুও। দু’-একটি তথ্যেই পরিস্ফুট হবে সবটা। প্রথম শ্রেণির গড়ে ভিক্টর ট্রাম্পার (৪৪.৫৭), ওয়ালি হ্যামন্ড (৫৬.১০), বিল পন্সফোর্ড (৬৫.১৮), ভিভ রিচার্ডস (৪৯.৪০) বা শচীন তেন্ডুলকরদের (৫৭.৮৪) পিছনে ফেলে দিয়েছেন জনৈক অজয় শর্মা (৬৭.৪৬)। এবং সুনীল গাভাসকারের (৫১.৪৬) টিকিও দেখা না গেলেও বিশ্বের প্রথম পঁচিশে চলেই আসেন কখনও টেস্ট না খেলা সুরেন্দ্র ভাবে (৫৮.১৮)। আসলে টেস্ট ক্রিকেটের মঞ্চে (যার খতিয়ান অন্তর্ভুক্ত হয় প্রথম শ্রেণির পরিসংখ্যানে) সাদা টুপি মাথায় গাভাসকারের চার ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলারের মহড়া নেওয়া আর ভারতবর্ষের মরা পিচে মধ্যগতির ঘরোয়া পেসারদের পিটিয়ে হাতের সুখ করাকে তো আর বসানো যায় না একাসনে।

ব্র্যাডম্যান, বার্নস, ভোজেস ও প্যাটারসনকে ব্যতিরেকে আর-এক অস্ট্রেলীয় মিডল-অর্ডার ব্যাটারও ঠিক ৬০.০০ গড়েই শেষ করতে পেরেছিলেন টেস্ট জীবন। সময়টা প্যাকার-কণ্টকিত ১৯৭৮-৭৯ মরশুম। মুস্তাক মহম্মদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পার্থ টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৫০) কিম হিউজের অস্ট্রেলিয়া ব্যাগি গ্রিন দিয়েছিল জেফ মসকে। দুই ইনিংসে যাঁর সংগ্রহ ছিল যথাক্রমে ২২ ও অপরাজিত ৩৮। কোনও অর্ধশতকের ইনিংসও না খেলেই অঙ্কের মারপ্যাঁচে ন্যাটা মস বনেই গিয়েছেন ব্র্যাডম্যানের জনৈক পড়শি।

গ্রেম পোলক ছাড়াও টেস্ট ক্রিকেটে ষাটোর্ধ্ব ব্যাটিং গড়ের আরও এক অধীশ্বরকেও পাওয়া যায় প্রোটিয়াদের দেশ থেকে। মান্য তালিকায় যদিও জায়গা হয় না তাঁর। তবে এঁর সম্পর্কে যেটা বলার, খোদ ব্র্যাডম্যান স্বনির্বাচিত বিশ্ব একাদশের ওপেনিং স্লটে আর্থার মরিসের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এঁকে। বিশ্ব ক্রিকেটের দুর্ভাগ্য, দেশীয় সরকারের ঘৃণিত নীতির মূল্য চোকাতে হয়েছিল ব্যারি রিচার্ডসের কেরিয়ারকে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চার টেস্টের ১৯৬৯-৭০ ঘরোয়া সিরিজ শেষে ব্যারির গড় দাঁড়িয়েছিল ৭২.৫৭। এবং তার পরপরই দীর্ঘ একুশ বছরের নির্বাসনে চলে যেতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

১৯৭০-৭১ মরশুম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে গাভাসকারের বিখ্যাত সেই আবির্ভাব সিরিজ। ব্র্যাডম্যানের চতুর্থ ক্যারিবিয়ান পড়শি হিসেবে এখানেই উত্থান জামাইকার উইকেটরক্ষক-ব্যাটার ডেসমন্ড লুইসের। ইনি এমন একজন মানুষ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যাঁর সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৯৬ (গড় ৩১.৮২)। সিরিজের শেষ তিন টেস্টে জর্জটাউন (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬৮৪), ব্রিজটাউন (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬৮৫) ও পোর্ট অফ স্পেনে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬৮৬) ব্যাট হাতে তাঁর অবদান ছিল যথাক্রমে অপরাজিত ৮১, ৮৮ ও ১৪ এবং ৭২ ও অপরাজিত ৪। কিন্তু নির্বাচকরা তেকাঠির পিছনে মাইকেল ফিন্ডলের উপর ভরসা রাখায় ৮৬.৩৩ গড় নিয়েও আর কখনও টেস্ট খেলা হয়নি তাঁর।

তসলিম আরিফের নিয়তিও কি লুইসের মতোই নয়! ওয়াসিম বারির সমসাময়িক হওয়ার দুর্ভাগ্যেই ষষ্ঠ টেস্টের পরপরই থেমে যায় তাঁরও কেরিয়ার। আবির্ভাবে ১৯৭৯-৮০ কলকাতা টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৭১) যদিও ওপেনার হিসেবেই খেলানো হয়েছিল তাঁকে। তবে বিশেষজ্ঞ ব্যাটার হিসেবে সমকালীন পাক ব্যাটিং লাইনআপে দীর্ঘ সুযোগ পাওয়া হয়তো সম্ভব ছিল না আরিফের। ১৯৮০-৮১ অবধি বিস্তৃত টেস্ট কেরিয়ারে একটি দ্বিশতরান সহ ৬২.৬২ গড়েই থমকে যেতে হয়েছে তাঁকে।

(ক্রমশ)