ঝুলন……. ঝুলন..

কেরিয়ারের শেষ বল করতে দৌড়োচ্ছেন চাকদাহের ডানহাতি পেসার। লর্ডস উচ্ছসিত। বাঙালি, ভারতীয়, নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান, ব্রিটিশ সবাই মিলেমিশে গিয়েছেন আজ। সমস্বরে উঠছে চিৎকার। ‘ঝুলন… ঝুলন’। সবাই দেখতে চায় তার শেষ আন্তর্জাতিক ডেলিভারিতে একটি উইকেট। ২৫৫টা হোক ২৫৬, সেটা বড়ো নয়, বরং ঝুলুদির শেষটা বেশ সিনেমাটিক হোক এটাই যেন কাম্য সকলের।
তিনি এলেন, বল রাখলেন লেংথে এবং একেবারে অফ-মিডলে ফেললেন একটু ধীরগতিতে এবং ফ্রায়া ডেভিস বেশ পরে রিএক্ট করে ডিফেন্ড করলেন সামনের পায়ে। একটু যেন হতাশ হলেন ঝুলন, কিন্তু তার সতীর্থরা তখন আবেগাচ্ছন্ন। একে একে এগিয়ে এলেন হার্মানপ্রীত কৌর, দীপ্তি শর্মা, যাস্তিকা ভাটিয়া। এসে আলিঙ্গন করলেন তাদের ঝুলুদিকে। না হোক শেষটা কবিতার মতো, তবুও দীর্ঘ কুড়ি বছরের পরিশ্রমী এক ক্রিকেটারের তো অবশ্যই প্রাপ্য এই সন্মান।


কুড়ি বছরের পরিশ্রম এবং স্বপ্ন। না! স্বপ্নটা ধাওয়া করা শুরু ২৫ বছর আগে। ইডেন গার্ডেন্সে ১৯৯৭ বিশ্বকাপ জয়ী অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরি ল্যাপ সেদিন এক বছর পনেরোর মেয়ের মধ্যে বুনে দিয়েছিল ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। চাকদহর মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মেয়ে। সাধারণ ক্ষেত্রে হয়তো গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স, চাকরি বা নিদেনপক্ষে বিয়ে- এই যেন ভবিতব্য হয়ে আসে। কিন্তু লক্ষ্য ছিল বৃহত্তর। সেই টানেই নিজের বাড়ি থেকে ৫০ মাইল এসে কলকাতার বিবেকানন্দ পার্কে স্বপন সাধুর কাছে প্র্যাক্টিস শুরু। সপ্তাহে তিনদিন এই যাওয়া-আসা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। বাংলার হয়ে এরপরে হয় অভিষেক এবং ২০০২ সালে চেন্নাইতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অভিষেক।
এরপরে কেটেছে একের পর এক বছর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য তিনি রেখেছেন একইভাবে। ইংল্যান্ড ক্রিকেটার অ্যামি জোন্সই বলেছেন তার ধারাবাহিকতার কথা। ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা তাকে বলেছেন “ওয়ানস ইন আ জেনারেশন ক্রিকেটার।”
ঝুলন যখন শুরু করেন তখন তিনি ছিলেন সুনিতা সিং, মমতা মাবেনের সঙ্গী। এরপর তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী হন শিখা পান্ডে। সেইখান থেকে আজ রেণুকা ঠাকুর এবং মেঘনা সিং। ২০১৬ সালের টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে বল বয় ছিলেন রেণুকা, একবার কানপুরের হোটেলের লবিতে ঝুলনের অটোগ্রাফ পাওয়ার জন্য সারাদিন দাঁড়িয়েছিলেন মেঘনা। আজ তাঁরা শেষ করছেন ঝুলনের সতীর্থ হিসেবে। এই পুরো যাত্রাতে এক এবং অদ্বিতীয় থাকার লড়াই থেকে গিয়েছে পুরো কেরিয়ারে।
ময়দানের বিখ্যাত কোচ একবার বলেছিলেন এক নম্বরে থাকার চেয়েও কঠিন এক নম্বর স্থান ধরে রাখা। ঝুলনের সেই স্থান ধরে রাখার লড়াইয়ে সর্বক্ষণ সঙ্গী ছিল অধ্যবসায়, কাঠিন্য এবং অবশ্যই লক্ষ্য তাড়া করার ক্ষমতা। এসেছে চোট-আঘাত, অন্য বাধা। কিন্তু সবকিছু তুচ্ছ করে এগিয়ে গিয়েছেন ঝুলন।


আজ তাঁর নামের পাশে রয়েছে ৩৫৫ আন্তর্জাতিক উইকেট। আজ তিনি ভারতের সর্বোচ্চ ওয়ান-ডে উইকেটশিকারি মহিলা ক্রিকেটার। একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। এইসব রেকর্ড কখনোই শুধুমাত্র রেকর্ডবুকে থেকে যাওয়ার নয়, বরং তা অনুপ্রেরণা যোগাবে একাধিক মহিলা ক্রিকেটারকে। অবশ্য শুধু মহিলা ক্রিকেটার কেন? যে কোনো মধ্যবিত্ত ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন নিয়ে বড়ো হওয়া মানুষ যখন দেখবে লর্ডসের মাটিতে এক ভারতীয় ক্রিকেটার তাঁর শেষ ইনিংসে ব্যাট হাতে নামার সময় পাচ্ছেন গার্ড অফ অনার। যখন সে শুনবে এক ভারতীয় ক্রিকেটারের বিদায়সূচক আবেগের সঙ্গে শুধু আসমুদ্রহিমাচলই নয়, বরং ভেসে গিয়েছিল সুদূর ব্রিটিশভূম, তখন সেও উদ্বুদ্ধ হবে নিজের আপাত অধরা মনে হওয়া স্বপ্নকে ছোঁয়ার।
ঝুলন হওয়া সহজ নয়। তাতে থাকে হেরে যাওয়ার ভয়, লোকমুখে নিজের অপরিণত মানসিকতার কথা শুনতে হয় প্রথমে। আসে অনেক কঠিন সময়। যে সময় সামনে তাকানো কঠিন হয়ে গেলেও মনের জোরে জিতে নিতে হয়। নিজেকে প্রতিটা হেরে যাওয়ার মুহূর্তে বলতে হয় “চিন আপ! তুমি যুদ্ধ হেরে যাওনি।” থাকতে হয় অদম্য জেদ।
এই সব ফ্যাক্টর সঙ্গী করে নিরন্তর চলা দীর্ঘ ২০ বছর ২৫৪ দিনব্যাপী লড়াইয়ে এক যোদ্ধার সফলতা কতটা সেটা আজকের লর্ডসের ‘ঝুলন ঝুলন’ চ্যান্ট, প্রতিপক্ষর দেওয়া গার্ড অফ অনার এবং সতীর্থদের আবেগ বুঝিয়েছে প্রতিপদে। ‘হোম অফ ক্রিকেটে’ এর চেয়ে বড়ো সন্মান আর কিই বা হতে পারতো!
অ্যাডিয়োস চাকদহ এক্সপ্রেস!