শিরস্ত্রাণ কেমন করে শিরোধার্য হয়েছে!

শক্ত-বলের ক্রিকেটে, তা সেই বলের রঙ লাল বা সাদা বা গোলাপি যাই হোক না কেন, ব্যাটারের সরঞ্জামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে সঙ্গের ছবির এই সরঞ্জামটি। এমনকি “দাদাগিরি” অনুষ্ঠানের শেষে ব্যাটাররূপী যে বালকটি প্রতিযোগীদের পুরস্কারগুলো এনে “দাদা”-র হাতে দেয়, সে পর্যন্ত প্যাড-গ্লাভসের সঙ্গে এটিও পরিধান করে থাকে! এটি ছাড়া ব্যাটারের অঙ্গসজ্জা যেন অসম্পূর্ণ। হ্যাঁ, আমি হেলমেট-এর কথা বলছি – বিগত প্রায় চার দশক ধরে হেলমেট ছাড়া ব্যাটার বিরল দৃষ্টান্ত।

না, আমার আজকের রচনা সেই আঙ্গুলে-গোনা বিরল দৃষ্টান্তদের (ভিভ রিচার্ডস বা সুনীল গাভাস্কর) নিয়ে নয়। আজ বরং একটু তাকাই এই হেলমেটের ব্যবহার প্রচলনের ইতিহাসের দিকে। এহেন খেয়ালের কারণ কী? সেটার জন্য একটু ধৈর্য ধরে রচনাটার শেষ পরিচ্ছেদটার জন্য অপেক্ষা করুন। তার আগে দ্রুত একবার চোখ রাখি ব্যাটারের (দৃশ্যমান ও অ-দৃশ্যমান) আরো তিনটি সুরক্ষা সরঞ্জাম – প্যাড, গ্লাভস ও বক্স – এদের ব্যবহারের গোড়ার কথায়। 

প্যাডের ব্যবহার, যতদূর জানা যায়, শুরু হয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। এই প্রচলনের ফলে লেগ-বিফোর-উইকেট বা এল-বি-ডব্ল্যু (LBW)-রও শুরু যাতে ব্যাটাররা পা দিয়ে বল আটকানো বন্ধ করেন, অন্ততপক্ষে কমিয়ে দিতে বাধ্য হন। গ্লাভসের ব্যবহার নাকি শুরু হয় ১৮৫০ সাল নাগাদ। আর Simon Hughes-এর “And God Created Cricket” অনুযায়ী, বক্সের চলন শুরু হয় ১৮৬০-এর দশকে যখন আন্ডার-আর্ম বোলিং করাই ছিল দস্তুর।

তাহলে দেখা গেল ব্যাটারদের পদযুগল-হস্তযুগল-জননেন্দ্রিয় এইসব অঙ্গের রক্ষার জন্য বিভিন্ন সরঞ্জামের ব্যবস্থা হলেও শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর অন্যতম মস্তকটি রক্ষা করা নিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধের পরেও অনেকদিন কোনও ব্যবস্থা ছিল বলে জানা যায়না, যদিও ব্যাটারদের মাথায়-মুখে আঘাত লাগার বহু ঘটনাই ঘটে গেছে – ১৯৬২-তে বার্বাডোজে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে সফরকারী ভারতীয় অধিনায়ক নরি কন্ট্র্যাক্টরের সেই দুর্ঘটনাটা তো সবচেয়ে কুখ্যাত।

১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে, ১৯৭৭ সালে, কেরি প্যাকারের মস্তিষ্কপ্রসূত World Series Cricket (WSC) প্রতিযোগিতায় ইংল্যান্ডের ওপেনার ডেনিস অ্যামিস একধরণের হেলমেট ব্যবহার করা শুরু করেন যা ছিল অনেকটা মোটর-বাইক চালকের crash helmet-এর মতন। না করে বোধহয় উপায়ও ছিলনা! কারণ? WSC-তে কোন কোন পেসার খেলতেন [এখানে WSC-তে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়দের সবার নামগুলোই দেওয়া আছে: https://willowrwill.com/2022/03/23/kerry-packer-45-yrs/], এবং কেমন ধরণের পিচে কতোখানি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলা হ’ত – সুযোগ পেলে সেসব গল্প পরে আরেকদিন করা যাবে।

অ্যামিসের মতন ঐরকম হেলমেট নাকি টনি গ্রেগও ব্যবহার করতেন যদিও তাঁর বক্তব্য ছিল যে এর ব্যবহারের ফলে বোলাররা বেশিসংখ্যক বাউন্সার দিতে উৎসাহিত হবেন! মাইক ব্রিয়ার্লি ও সুনীল গাভাস্কর কিছুদিন ব্যবহার করতেন একধরণের skull-cap যা তাঁরা টুপির নিচে পরতেন। সঙ্গের ছবিগুলো দেখুন। টেস্ট-ম্যাচে কখনওই হেলমেট ব্যবহার-না-করা শেষ ব্যাটার ছিলেন ভিভ রিচার্ডস, যিনি ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।

যতদূর জানা গেছে, ১৯৭৮-এর ১৭ই মার্চ ব্রিজটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে (সিরিজের দ্বিতীয়) টেস্ট-ম্যাচে হেলমেট ব্যবহারকারী প্রথম ব্যাটার অস্ট্রেলিয়ার গ্রাহাম ইয়ালোপ। এজন্য মাঠের কিছু দর্শক তাঁকে সমস্বরে বিদ্রুপও করেন। তাতে অবশ্য ইয়ালোপ কোনও ভ্রুক্ষেপও করেননি কারণ বিপক্ষদলের বোলাররা ছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস, কলিন ক্রফ্ট ও জোয়েল গার্নার, এবং ঠিক দু’সপ্তাহ আগেই, ৩রা মার্চ, তার আগের টেস্টের প্রথম দিনে রবার্টসের বাউন্সারে সহ-খেলোয়াড় পিটার টুহি-র অবস্থাটা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন!!

১৯৮০-র দশকের গোড়া থেকেই, বিশেষত ১৯৭৯-৮০ মরশুমে WSC-র সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেট-দুনিয়ার সমঝোতা হয়ে যাওয়ার পরে, হেলমেটের নিয়মিত ব্যবহার চালু হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার Albion Sports Technology-ই প্রথম সংস্থা যারা হেলমেট তৈরি করা শুরু করে। পরে অবশ্য বিশ্বে বহু সংস্থাই এই কাজ করেছে ও করে চলেছে।

তাহলে দেখা গেল যে ১৯৭০ দশকের শেষের দিক পর্যন্ত হেলমেটের ব্যবহারের চলন ছিলনা বললেই হয়। তার আগে অবশ্য বিক্ষিপ্তভাবে কোনও কোনও ক্রিকেটার নিজের মতন ক’রে মোটা রুমাল/তোয়ালে বা রাবার-প্যাডিং দিয়ে তাঁদের মাথা (আক্ষরিক অর্থেই) বাঁচানোর চেষ্টা করতেন/করেছিলেন। এমনই একজন ব্যাটারের স্ত্রী, Minnie, মোটা রাবার-প্যাডিং ব্যবহার করে তাঁর স্বামীর জন্য এক বিশেষ ধরণের টুপি বানিয়েছিলেন এবং সেই ক্রিকেটার সেই টুপি পরে ম্যাচে ব্যাটিংও করেছিলেন। এবার সেই ঘটনার বর্ণনাই দিতে চলেছি। অনুগ্রহ করে আরেকটু ধৈর্য ধরুন। Abhishek Mukherjee-র এক রচনার কিছুটা সাহায্য নেওয়া যাক।

তখন সদ্য-সমাপ্ত Bodyline series-এর পরের মরশুমে, ১৯৩৩ সালে, ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট শুরু হয়েছে এবং জ্যাকি গ্র্যান্টের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল এসেছে ইংল্যান্ড সফরে। এর আগে তারা ১৯৩০ সালে নিজেদের দেশে (অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ) ইংল্যান্ড দলকে সিরিজে ২-১ হারিয়েছে, এবং ১৯৩০-৩১ মরশুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্র্যাডম্যান-পন্সফোর্ড-উডফুল-কিপ্যাক্স-ম্যাককেব-ওল্ডফিল্ড-গ্রিমেট-আয়রনমঙ্গার সম্বলিত অজিদের বিরুদ্ধে (সিরিজ ১-৪ হারলেও) সিডনি-টেস্টে জিতেছে। দলে রয়েছেন জর্জ হেডলির মতন ব্যাটার, লিয়ারি কনস্ট্যান্টাইনের মতন পেসার অল-রাউন্ডার, আছে মার্টিনডেল-গ্রিফিথ-ফ্রান্সিস এঁদের নিয়ে তীব্র পেস-আক্রমণ। ১৯৩০-এ ক্যারিবিয়ানে মার্টিনডেলের এক বাউন্সারে ইংল্যান্ড-অধিনায়ক বব ওয়্যাট-এর চোয়াল চার-টুকরো হয়ে গেছিল। David Frith-এর “The Fast Men” অনুযায়ী, “Martindale and Constantine were not reluctant to give the Englishmen a taste of their own medicine. …  The duo was working on the orders of their captain, Jackie Grant.

হুক-পুল শট মারায় বিশেষ পারদর্শী, ইংল্যান্ড-তথা-মিডলসেক্স-কাউন্টির বিখ্যাত ব্যাটার, (তখন) ভাল ফর্মে-থাকা প্যাটসি হেনড্রেন [৩০-বছরব্যাপী প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট-জীবনে যাঁর মোট ৫৭,৬১১ রান বিশ্বে তৃতীয় ও মোট ১৭০টা সেঞ্চুরি বিশ্বে দ্বিতীয়] সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন লর্ডস মাঠে MCC-র হয়ে ম্যানি মার্টিনডেল ও লিয়ারি কনস্ট্যান্টাইন জুটির মুখোমুখি হওয়ার জন্য। বলে রাখা দরকার যে, ১৯৩১ সালে লর্ডসে নটিংহ্যাম দলের বিরুদ্ধে এক কাউন্টি-ম্যাচে লারউড-ভোস জুটির বিপক্ষে মাথায় আঘাত পেয়ে স্ট্রেচারবাহিত হয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ম্যাচে তিনি আর অংশ নিতে পারেননি, মাথায় গোটা-ছয়েক সেলাই করতে হয়েছিল।

লর্ডসে MCC-র বিরুদ্ধে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং-করা ওয়েস্ট ইন্ডিজের (হেডলির ১২৯ সমেত) ৩০৯ রানের জবাবে শুরুতেই MCC-র নড়বড়ে অবস্থা – ম্যানি-লিয়ারি পেসার জুটির হাতে পড়ে দিনের শেষে ২-৩৩। ম্যাচের দ্বিতীয় দিন সকালে হেনড্রেন যখন ব্যাট করতে নামলেন, তখন: “The hearts of the Lord’s crowd skipped a collective beat when they saw Hendren walk out on the second morning. It was not something they have seen before. Hendren was wearing a cap, and yet it was not a cap. It was not anything remotely similar to what they had seen on a cricket field.

টুপিটার বর্ণনা: “Cricket caps have a single peak. Hendren’s had three. One of them was the conventional, erect one — the one that carried the badge of the team, the one that made players proud of their identity. The other two hung limply, one on each side of his head. …  The ‘helmet’ was a cap with three peaks, two of them covering his ears and temples, lined with foam rubber.” ছবি দেখুন।

নিজের স্ত্রীর তৈরি-করা এই টুপি সম্বন্ধে হেনড্রেন স্বীকার করেন যে নতুন-ধরণের (পড়ুন Bodyline ধাঁচের) বোলিংয়ের শর্ট-পিচ বাউন্সারে দু’বছর আগে মাথায় আঘাত পাওয়ার পর তাঁর বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল। লর্ডসের মতন ঐতিহ্যমন্ডিত মাঠে এই শিরস্ত্রাণ পরিধান করে তাঁর আবির্ভাব নিয়ে ক্রিকেট-মহলে রীতিমতন হৈচৈ পড়ে যায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রচুর মন্তব্য প্রকাশিত হয় – কয়েকটা দিলাম: 

  • Ridiculous – a cross between an airman’s helmet and an Eskimo’s headgear.
  • “Patsy’s protective headgear looks like Sherlock Holmes’ hat.
  • Hendren’s three-peak cap has cracked another glorious cricket tradition. … a strangely head-muzzled figure, suggesting baseball or fencing or a bout wrestler, walked up to the wicket.
  • A kind of deerstalker hat, having the side-effect of converting his appearance from that of an amiable but hungry bull mastiff into that of an amiable but hungry bloodhound.” 

যথার্থভাবেই, হেনড্রেন তাঁর এই ‘হেলমেট’ ব্যবহার সমর্থন করেন: “The people can say what they like. I have been hit on the head four times, once by a Larwood bouncer in 1931 which caused a wound in which six stitches were inserted. I am still suffering recurrent headaches due to that bashing. Believe me, I’m taking no more risks. … it protects the temples. I don’t mind my face altered or my teeth knocked out if my head is protected. I don’t think other players will get similar caps. They wear pads and abdominal and chest protectors but have not the courage to wear a head protector.” শেষ বাক্যাংশটা [‘courage to wear a head protector’] লক্ষ্য করুন। তবে এত হৈচৈয়ের পরিপ্রেক্ষিতে একধরণের আপোষ করতে তিনি পরে রাজি হন এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে লারউড-ভোস, বাওয়েস, এবং কনস্ট্যান্টাইন-মার্টিনডেল ছাড়া আর কোন বোলারের বিরুদ্ধে তিনি ঐ ‘হেলমেট’ ব্যবহার করবেন না।

সময়ের (এবং আরো কিছু ক্রিকেটীয় দুর্ঘটনা ঘটবার) সঙ্গে সঙ্গে মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টেছে/পাল্টাচ্ছে। ফিরে আসি সত্তর দশকের শেষে – ১৯৭৯ সালে Wisden-এর সম্পাদক Norman Preston ব্যাটারদের সুরক্ষার স্বার্থে হেলমেটের বহুল ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেন। তার প্রায় চার দশক বাদে, ২০১৭ সালে, ‘যথেষ্ট সুরক্ষাযুক্ত হেলমেট’-এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে প্রতিটি ক্রিকেট-খেলিয়ে সদস্য দেশকে ICC অনুরোধ করেছে [https://www.icc-cricket.com/news/311699] – আপনাদের কী মনে পড়ছে “মুন্ড গেলে খাবোটা কী, মুন্ড ছাড়া বাঁচবো নাকি?” সত্যজিতের রচনা-সুরারোপ করা “গু-গা-বা-বা”-র সেই গানটা!

ও হ্যাঁ, তালেগোলে জানাতে ভুলেই যাচ্ছিলাম হেনড্রেন ঐ ‘হেলমেট’-টা ব্যবহার করেছিলেন ২২শে মে, ১৯৩৩ সালে – আজ থেকে প্রায় নয় দশক আগে। আজ তাই ‘ব্যাটার শিরস্ত্রাণ-বার্ষিকী’!