রনজি ট্রফির রুদ্ধশ্বাস ফাইনালের শেষ কয়েক ঘন্টা

ফাইনাল শুরুর আগে থেকেই ছিল বাতাসে বারুদের গন্ধ। একদিকে নয় নয় করে  ৮ জন টেস্ট ক্রিকেটার-পুষ্ট বোম্বাই, অন্য দিকে প্রায় নামগোত্রহীন হরিয়ানা। প্রশ্নটা পাক খাচ্ছিল — কপিলদেব, চেতন শর্মা, অজয় জাদেজার সম্মিলিত শক্তি কি পারবে সঞ্জয় মঞ্জরেকর, দিলীপ বেঙ্গসরকার, শচীন তেন্ডুলকার, বিনোদ কাম্বলিদের অভিজাত বোম্বাইয়ের (তখনও মুম্বই হয়নি) রঞ্জি-প্রাধান্যে আঁচড় কাটতে?

১৯৯০-৯১ রঞ্জি ফাইনালে আমাদের কাহিনীর পর্দা উঠবে আজকের তারিখে (৭ মে)। টান-টান উত্তেজনায় টইটম্বুর শেষ দিনে। তার আগে ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি কীভাবে ম্যাচটা এইরকম চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছালো। হরিয়ানার (৫২২ রান) প্রথম ইনিংসের ব্যাটিং সংগ্রামে ছিল দীপক শর্মা (১৯৯), অজয় জাদেজা (৯৪) এবং ৮ নম্বরে-নামা চেতন শর্মার (৯৮) অভাবিত ব্যাটিং বিক্রম। অথচ, যোগেন্দ্র ভান্ডারি( ৫/১১৮) আর কপিলদেবের (৩/৫৪) স্পিন-পেসের সাঁড়াশি চাপে সঞ্জয় পাটিলের ৮৫, লালচাঁদ রাজপুতের ৭৪ সত্ত্বেও বোম্বাই আটকে গেল ৪১০ রানে! অবশ্য, অজয় ব্যানার্জীর অপরাজিত ৬০, কপিলের ৪১ সত্ত্বেও সলিল আঙ্কোলা আর সঞ্জয় পাটিলের স্যুইং-এ (দু’জনেই ৩ টি করে উইকেট) হরিয়ানাও গুটিয়ে যায় ২৪২ রানে। চতুর্থ ইনিংসে বোম্বাইয়ের জয়ের টার্গেট দাঁড়ায় ৩৫৫ রান।হাতে ১৯০ মিনিট আর বাধ্যতামূলক ২০ ওভার।

এই উত্তপ্ত আবহে, উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার দোলাচলে বোম্বাই শুরুতেই ৩ উইকেট হারায় মাত্র ৩৪ রানে! ওয়াংখেড়ে জুড়ে তখন শুনশান নীরবতা। বেঙ্গসরকারের সঙ্গে জুটি বাঁধলেন উঠতি প্রতিভা শচীন তেন্ডুলকার। শুরু থেকেই পাল্টা অ্যাটাকে নামলেন তিনি। কিন্তু মাত্র ৭৫ বলে ৫ টি দর্শনীয় ওভার বাউন্ডারিসহ নিজের ৯৬ রানে আচমকাই ভান্ডারির বলে ক্যাচ তুলে আউট হয়ে গেলেন শচীন। জুটিতে ১৩৪ টি রান যুক্ত হল বটে কিন্তু জয়ের লক্ষ্য তখনও বহু দূরে। বিনোদ কাম্বলিও মাটি কামড়ে ৪৫ রান করে, ৮১ রানের পার্টনারশিপ দিয়ে ফিরে গেলেন সাজঘরে।

বাধ্যতামূলক কুড়ি ওভারের খেলা যখন শুরু হচ্ছে, বোম্বাইয়ের রান তখন ২৪১/৪। জেতার জন্য চাই ১১৪ রান, হাতে অক্ষত ৬ টি উইকেট। দাঁড়িপাল্লায় ম্যাচটা তখন একেবারে ফিফটি-ফিফটি। আর ঠিক এই সময়ে বোম্বাইয়ের ব্যাটিংয়ে ধস নামল আচমকাই। ম্যাচটা আবার সুইং করল হরিয়ানার দিকে। লাস্টম্যান, ফাইনালে আবির্ভাব ম্যাচ খেলতে-নামা, আবে কুরুভিল্লা যখন মঞ্চে এলেন তখনও জয়ের টার্গেট ৫০ রান দূরে। তবে সমর্থকদের যাবতীয় আগ্রহ আর মনোযোগের কেন্দ্রে তখন একজনই, ৯৮ রানে অপরাজিত দিলীপ ‘কর্নেল’ বেঙ্গসরকার। কিন্তু সমস্যা হল, মে মাসের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় দিলীপের পায়ে এমন টান ধরল যে শেষপর্যন্ত তাঁর হয়ে ‘রানার’ হিসাবে দৌড়বার জন্য ডাকতে হল লালচাঁদ রাজপুতকে। বেঙ্গসরকার বুঝে গেলেন লাস্ট উইকেটে পাল্টা আক্রমণে না গেলে লড়াইটাই শেষপর্যন্ত মিথ্যে হয়ে যাবে। প্রথম ইনিংসের সবচেয়ে সফল স্পিনার যোগেন্দ্র ভান্ডারিকেই বেছে নিলেন আক্রমণের জন্য। প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে নিজের সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন। এবং সেই ওভারেই মারলেন আরও দুটি ছক্কা আর দুটি চার। এক ওভারেই উঠে এল ২৬ রান। আর চাই ২৪ রান। এবার কপিল নিজেই এলেন বল করতে। প্রথম বল, সোজা এসে লাগল কুরুবিল্লার প্যাডে। বোলার, উইকেটকিপার, আর সমস্ত ফিল্ডারের সমবেত আউটের আবেদন আকাশ ছুঁয়ে ফিরে এলেও আম্পায়ার নির্বিকার। পরে চেতন শর্মা বলেছেন “জীবনে কপিল পাজিকে এত রাগতে আমি কখনও দেখিনি।”

অতঃপর ১৮-তম ওভারের চতুর্থ ডেলিভারিটি যখন সেই চেতন শর্মা শুরু করতে যাচ্ছেন, তখন হারের আতঙ্কে হাঁসফাঁস করছে হরিয়ানা। কারণ তখন বোম্বাইয়ের জেতার জন্য দরকার মাত্র তিন রান, হাতে ১৫ টি বল। লেগ-স্টাম্পের ওপর বল ফেললেন চেতন। স্কোয়ার লেগে ঘুরিয়েই ছুটতে শুরু করলেন কুরুবিল্লা। বল থামাতে প্রাণপণ ছুটলেন অমরজিৎ কেপি। এক রান কমপ্লিট। দ্বিতীয় রানের সময় শোনা গেল কিছু ভুল বোঝাবুঝির ‘ইয়েস’, ‘নো’। এর মধ্যেই অমরজিতের নিখুঁত থ্রো ফিরল উইকেটকিপার বিজয় যাদবের গ্লাভসে। উৎকণ্ঠার টানাপোড়েনে তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে প্রথমবার ফস্কালেও দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় উইকেট ভেঙে দিলেন যাদব। গোটা স্টেডিয়াম স্তব্ধ। শুধু মাঠের মধ্যে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আনন্দে শিশুর মতো লাফালাফি করছেন হরিয়ানার ক্রিকেটাররা।


একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে সকলের চোখ আটকে গেল এক অদ্ভুত দৃশ্যে। স্কোয়ার-লেগ আম্পায়ারের জায়গায় তখনও হাঁটু মুড়ে বসে মুখ নিচু করে কাঁদছেন ১৩৯ রানে অপরাজিত দিলীপ বেঙ্গসরকার।লড়াইয়ের হাতিয়ার তাঁর ‘পাওয়ার’ ব্যাটটি হেলা ভরে পড়ে আছে দূরে। কর্নেল বুঝতে পারছিলেন আজকের এই আনন্দযজ্ঞে তাঁর লড়াইয়ের আর কোনও দামই রইল না। কপিলদেবের নেতৃত্বে বোম্বাইয়ের মাটিতে মাত্র দু রানে বোম্বাইকেই হারিয়ে প্রথম রনজি ট্রফি পেল হরিয়ানা।