ইডেনে আমার অভিষেক এবং গ্যারি সোবার্স

“চল্, তোকে আজ একটা দারুণ জিনিস দেখিয়ে আনি”, ছুটির দিন সক্কাল-সক্কাল চা খেতে খেতে বলল মানসদা। আমার এলাহাবাদ-প্রবাসী মেজোপিসিমার এই ছোটো ছেলেটি তখন আমাদের কোলকাতার সাদার্ন মার্কেটের ঠিক পেছনকার সেই ভবানন্দ রোডের ভাড়াবাড়িতে আমাদের সঙ্গেই থাকত, আর কাজ করত ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালসের হেড অফিসে। খুব হৈ-চৈ করতে পারত, আমাকে খুব ভালোবাসত, আর ছিল খেলা-পাগল। ছুটির দিন তার সঙ্গে বাড়ির গায়ের সরু গলিতে প্রায়ই আমার ‘পতৌদি’ হওয়ার ব্যাটিং-সাধনা চলতো টেনিস বল দিয়ে!

ছবি: সৌজন্যে Brian Levison-এর “Remarkable Cricket Grounds”

কথা শুনেই তো আমি চোঁ-চোঁ করে হাতের বোর্নভিটার কাপটা শেষ করে একপায়ে খাড়া। চটপট স্নান সেরে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে একটা (কালো-হলুদ) অ্যাম্বাসাডর ট্যাক্সি ধরে সোজা ইডেন গার্ডেন্স; ওর লাগোয়া সুন্দর বাগানটায় আমি বাবার সঙ্গে আগে একবার গিয়েছি, প্যাগোডা দেখেছি, আইসক্রিম খেয়েছি; কিন্তু এবার এক সম্পূর্ণ অন্য অভিজ্ঞতা।

আপনারা যাঁরা শঙ্করীপ্রসাদ বসুর “ইডেনে শীতের দুপুর” পড়েছেন, তাঁরা এই বিস্ময়টা কিছুটা বুঝবেন। যাঁরা তা পড়েননি, তাঁরা শংকরের “কত অজানারে” মনে করে হাই কোর্টের বদলে (ঠিক পার্শ্ববর্তী) ইডেন গার্ডেন্স ভেবে নিন। যাঁরা তাও পড়েননি, সেই সব হতভাগ্যদের এই ‘পোস্ট-করোনা’ কালে যথাশীঘ্র সম্ভব এই দুটো বই ডাউনলোড করে পড়ে নেওয়া অবশ্যকর্তব্য বলে আামার মনে হয় [আমার এই ধৃষ্টতা নিজগুণে ক্ষমা করবেন, প্লিজ!]

আসল কথায় আসি। সেটা খুব সম্ভবতঃ ১৯৬৪ সাল, এপ্রিল মাস। গরম পড়তে শুরু করেছে। খোলা গ্যালারিতে রোদ বেশ কড়কড়ে হচ্ছে। কিন্তু আমার সামনে “সবুজ দিগন্তে এখন ম্যাজিক” [সেই যে আরেক রায় – ‘কান্ডজ্ঞানী’ তারাপদ – তাঁর কবিতা থেকেই ধার করে বলি!] – খেলা যে শুরু! কোন খেলা? জেনে নিন।

“E W Swanton, a famous British journalist and sportswriter, organized and managed a Commonwealth XI, including Sobers, Benaud, the Nawab of Pataudi, Sonny Ramadhin, Seymour Nurse, Richard Hutton (son of Sir Len), etc. that played against an Indian XI (led by Chandu Borde) at Calcutta in April-1964.”

ঘন্টাদুয়েক বাদে ক্রিকেটের সেই ম্যাজিক-আবেশ ভেঙ্গে দিয়ে মানসদা বলল, “চল, তোকে এবার বাড়ি দিয়ে আসি। ভাত খেয়ে তো আসিসনি আর এই চড়চড়ে রোদ। আর দেরি করলে ছোটোমামা রাগ করবে, মামী খুব চিন্তা করবে, তোর শরীর খারাপও করতে পারে।“ (“ছোটোমামা”, অর্থাৎ আমার পিতৃদেব, একটু নিয়মনিষ্ঠ মানুষ।)

আমার তো মাথায় বজ্রাঘাত! ওই ‘উল্টোহাতে’ ব্যাটসম্যানটার [তখনও ‘রাজনৈতিকভাবে সঠিক’ “ব্যাটার” কথাটা চালু হয়নি!] খেলা শেযতক না দেখে “পাদমেকং ন গচ্ছামি”। পরের মিনিট-দশেক ধরে মানসদার অনুনয়-বকাবকি-ভয়দেখানো সব বিফল [কেন যে ছাই সবাই দ্রাবিড় বা পূজারাকে ‘দ্য ওয়াল বলে? আমার সেই স্টোন-ওয়ালিং তো আর দেখেনি!]

অতএব গ্যালারির পেছনের স্টল থেকে কেনা দুটি শসার স্যান্ডউইচ আর একটি ডিমসেদ্ধর সঙ্গে কলের “বিশুদ্ধ পানীয় জল” দিয়ে আমার লাঞ্চ; তারপর …

দিনের শেষ অবধি খেলা দেখে সেই ‘উল্টোহাতে’ ব্যাটসম্যানটার সেঞ্চুরিতে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে আনন্দে ভাসতে ভাসতে চৈত্রের কড়া রোদে-ঝলসানো চেহারা নিয়ে শেষ বিকেলে বাড়ি ফেরা।

বাড়ি ফিরে বাবার বকুনি, মায়ের অনুযোগ,আর মানসদার কৈফিয়তের মাঝে আমার বাকি জীবনটার মনের খোরাক জোগাড়ের একটা ভিত গেঁথে দিল ইডেনের সবুজ ঘাসে জাদু-দেখানো সেই ‘উল্টোহাতে’ ব্যাটসম্যানটা – বাঁ-হাতি গ্যারি সোবার্স!

ছবি: ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ থেকে

আমার ক্রিকেট-প্রেম যে এত প্রগাঢ় হবে তাতে আর আশ্চর্য্ কোথায়? জীবনে প্রথম সত্যিকারের ক্রিকেট ম্যাচ আমি দেখি ইডেন গার্ডেন্সে, আর সেঞ্চুরি করে সেখানে আমাকে স্বাগত জানান গ্যারি সোবার্স – আর কোনও কথা আছে!!!

আর হ্যাঁ, “থ্যাঙ্ক ইউ, মানসদা” …