‘কে প্রথম?’ ‘কবে প্রথম?’ এই জাতীয় প্রশ্নের মধ্যে একটা ‘কুইজ-কুইজ’ গন্ধ থাকে। ‘জয়জয়ন্তী’ সিনেমায় অপর্ণা সেনের লিপে ‘কে প্রথম চাঁদে গেছে, বলো তো নাম ?’—গানটির কথা অনেকেরই হয়তো মনে পড়ে যাবে। তেমনই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেটা একটু বলে রাখা যাক।
ভারতীয় ক্রিকেটের টেস্ট গরিমা নিয়ে আমরা এখন মাথা উঁচু করে আলোচনা করি। আপাতত তিনে থাকলেও টেস্টে অল্প কিছুদিন আগেও ভারত এক নম্বরে ছিল। সকলের নয়, কারও কারও নিশ্চিত মনে আছে, ১৯৫২ সালের সেই গর্বের দিনটার কথা। হ্যাঁ, ঠিক ৭০ বছর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভারতবর্ষের মানুষ ‘সর্বপ্রথম’ দু’কান ভরে শুনেছিল ‘প্রথম’ টেস্ট জয়ের অবিশ্বাস্য সংবাদ! ভাবতে আজও ভালো লাগে, সেই অনাস্বাদিত অমৃতধারা ভারতের মাটিতে আনার ক্ষেত্রে দুই বঙ্গ-সন্তানেরও দৃপ্ত ও কুশলী ভূমিকা ছিল।
সেবার ইংল্যান্ড এসেছিল ভারত সফরে। অনেকেই বলেন, কমজোরী ভারতের বিরুদ্ধে পুরো শক্তির দল পাঠায়নি ইংল্যান্ড। হয়তো এই উন্নাসিকতার অন্যতম কারণ ততদিনে ইংল্যান্ডের প্রায় ৩০০-ছুঁইছুঁই টেস্ট খেলা হয়ে গেছে। একটু ‘আন্ডার-এস্টিমেট’ করেই তারা আনেনি হাটন, এডরিচ, কম্পটনের মতো ব্যাটার আর বেডসার, লেকারের মতো নামী বোলারদের। অবশ্য কি যুক্তিতে তারা পূর্ণশক্তির দল আনেনি সেটা ভাবার বিষয় ভারতের ছিল না। কানপুরে ভারতকে ৮ উইকেটে হারিয়ে যখন তারা ১-০ এগিয়ে সিরিজের পঞ্চম টেস্ট খেলতে এল, তখন কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি মাদ্রাজে কোন ম্যাজিক অপেক্ষা করে আছে। ১৯৩২ সালে টেস্ট ক্রিকেট শুরু-করা ভারতের কাছে সেটা ছিল ২৫-তম টেস্ট।
নাইজেল হাওয়ার্ড চোট পাওয়ায় নেতৃত্বের ভার চাপে ডোনাল্ড কার-এর কাঁধে। টস জিতে প্রাথমিক কাজটা অবশ্য তিনি করলেও জ্যাক রবার্টসন (৭৭) এবং ডিক স্পুনার (৬৬) ছাড়া আর কেউ বাঁ-হাতি ভিনুর স্পিন ভেল্কির (৮/৫৫) সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। মাত্র ২৬৬ রানেই ইনিংস শেষ করে ইংল্যান্ড। উইকেটকিপার প্রবীর সেন (ময়দানে পরিচিত ছিলেন খোকন নামে) একাই ভিনুর বলে চার-চারটি ‘স্টাম্প’ করে নতুন নজির গড়েন (দ্বিতীয় ইনিংসেও একটি স্টাম্পিং)। পাল্টা ব্যাট করতে নেমে স্ট্যাথাম-রিজওয়ে-ট্যাটারসলদের আক্রমণ সামলে ১৫-টি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে পঙ্কজ রায় খেলেন ১১১ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। এটি ছিল পঙ্কজ রায়ের সিরিজে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। পরবর্তী পর্বে দাত্তু ফাদকার (৬১) ও পলি উম্রিগড়ের (১৩০ নট আউট) ব্যাটে ভর করে ভারত ইনিংস ডিক্লেয়ার করে ৪৫৭/৯-তে। দ্বিতীয় ইনিংসে ভিনু মানকাদ (৪/৫৩) আর গুলাম আহমেদের (৪/৭৭) স্পিনের যুগলবন্দীতে ইংল্যান্ড মুড়িয়ে যায় মাত্র ১৮৩ রানে। ভিনু ম্যাচে ১২ উইকেট তোলেন মাত্র ১০৮ রান খরচ করে। প্রথম ইনিংসের মতো জ্যাক রবার্টসন ৫৬ রান করলেও বিজয় হাজারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সিংহের লেজ মুড়িয়ে ভারত টেস্ট জেতে ইনিংস ও ৮ রানে।
এযাবৎ ভারত নয়-নয় করে ৫৬০ টি টেস্ট খেলেছে। কিন্তু ওই যে বলছিলাম, আজ ঝলমলে প্রভাব আর অহংকারী উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও, কিছু কিছু ঘটনা ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে অক্ষয় আনন্দে আজীবন বেঁচে থাকে স্মৃতি আর সূর্যের আলোয় ।