আজ শুরু করি শঙ্করীপ্রসাদ বসুর “ইডেনে শীতের দুপুর” বইটার থেকে গোটাদুয়েক পরিচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে, রচনাকাল ১৯৬০ সালের ২৪শে/২৫শে জানুয়ারি, ইডেনে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া পঞ্চম টেস্ট চলাকালীন:
“’কে লইবে মোর কার্য?’ – সন্ধ্যারবির এই প্রশ্নের উত্তরে জগৎ নিরুত্তর ছবি থেকে গিয়েছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-রবি ব্র্যাডম্যান যখন স্বেচ্ছাবসান বরণ করলেন, তখন তাঁর কার্যভার গ্রহণ করবার জন্য অনেকেই ব্যস্ত হয়ে উঠল। বিশেষত অস্ট্রেলিয়ানরা। কারণ বীরের আসন পূর্ণ না হ’লে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে অরাজকতা আসবে। তাই আগামী-ব্র্যাডম্যান ও আগত-ব্র্যাডম্যানে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-মাঠ ভর্তি হয়ে গেল। ভিড় পরিষ্কার হতেও দেরি হ’লনা। দু’জন ছোকরা তার মধ্যে দাগ কাটল – কিছু পূর্ববর্তী ইয়ান ক্রেগ ও নিতান্ত বর্তমানের নর্ম্যান ও’নীল। ইয়ান ক্রেগ-রূপী ব্র্যাডম্যান অকালে ক্রীড়াত্যাগ করছেন, মাঠে আছেন নর্ম্যান ও’নীল। তাঁকে অনেক পথ হাঁটতে হবে ব্র্যাডম্যান-শিখরে পৌঁছবার পূর্বে।
কোনও দিন সত্যই পৌঁছবেন কী? ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারেনা, ভবিষ্যৎ-বক্তৃতার সহজ অধিকারসম্পন্ন ক্রিকেট-লেখকও না। কোনও একটি খেলার জন্য ব্র্যাডম্যান মহান নন, বহু সময়ের বহুসংখ্যক অসামান্যের জন্যই তাঁর মহিমা। ও’নীলের ভবিষ্যৎ-জীবন কতখানি দীর্ঘায়িত হবে তার উপরেই নির্ভর করছে তাঁর ব্র্যাডম্যানত্ব। এখন বর্তমানে নিবদ্ধ থাকাই ভাল।“
হঠাৎ ক’রে প্রায় তেষট্টি বছর আগেকার পুরোন কাসুন্দি ঘাঁটছি কেন? কারণ, আজ থেকে সাত দশক আগে, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক থেকে পরবর্তী অন্তত প্রায় এক দশক ধরে অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত ধরণের ক্রিকেটপ্রেমীরা খুঁজে গেছেন এমন একজন উদীয়মান তরুণ প্রতিভাবান ব্যাটারকে যাঁকে বলা যায় ‘ব্র্যাডম্যানের উত্তরসূরী’ – শঙ্করীপ্রসাদের কথায়, যিনি সেই ‘বীরের আসন’ পূর্ণ করবেন – ইয়ান ক্রেগ (১৯৫৩— ১৯৫৮) ও নর্ম্যান ও’নীল (১৯৫৮—১৯৬৫) এই দুজনের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন। আসুন, ডনের এই দুই (তথাকথিত) উত্তরসূরীদের নিয়ে দু-চার কথা শোনা যাক আজকে, ২৭শে অগাস্ট, ডনের এই জন্ম-বার্ষিকীর দিনে। শুরু করি ক্রেগ-কে দিয়ে।
ইয়ান ক্রেগ [১৯৩৫—২০১৪]
আগেই বলেছি, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাট হাতে কোনও তরুণ প্রতিভা দেখলেই অস্ট্রেলীয় জনতা তাঁকে ‘পরবর্তী ব্র্যাডম্যান’ ব’লে অভিহিত করতেন। ১৯৫১-৫২ মরশুমে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক ম্যাচে নিউ সাউথ ওয়েলস-এর (NSW) সাড়ে-১৬-বছরের ইয়ান ক্রেগ যখন ৯১ রানের একটা ইনিংস খেলেন, তখন বিল ও’রিলি-র মতন ক্রিকেট-প্রজ্ঞাবান সাংবাদিকও তাঁকে “a much more fully developed batsman than Bradman was then (at his age)” ব’লে প্রশংসা করেন। প্রত্যাশার চাপের সেই শুরু!
সেই চাপ আরো বাড়ল পরের বছর যখন ১৯৫২-১৯৫৩ মরশুমে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বিরুদ্ধে NSW-এর হয়ে ক্রেগ ২১৩* রান করলেন ছ’ঘন্টার সামান্য বেশিক্ষণ ব্যাট ক’রে – দলকে টেনে তুললেন ৮০/৩ থেকে ৪১৬/৭ডি পর্যন্ত। অধিনায়ক কিথ মিলার-এর মতন মারকুটে ব্যাটারের সঙ্গে ১৫৯ রানের জুটিতে মিলার করেন ৫৮ রান। ঐ ইনিংসের ছ’দশকেরও বেশি সময় পরে বহুদর্শী ক্রিকেট-লেখক ডেভিড ফ্রিথ বলেন: “I think that is still the most remarkable innings I’ve ever watched.” মিলার এমনও বলেন: “For a boy of his age, it was an unbelievable innings. He hit almost every shot off the meat of the bat, very little that was streaky or off the edge. He had the composure through it all that many veterans could not have matched.” তিনি অবশ্য সাবধানবাণীও দেন এই প্রতিভাবান তরুণটির ওপর অত্যধিক চাপ তৈরি না করতে।
ঐ মরশুমে সিডনির তৃতীয় টেস্টে ক্রেগ দলে না থাকায় দর্শকদের একাংশ বেশ ক্ষুদ্ধ হন। অ্যাডিলেডে পরের টেস্টে তিনি দ্বাদশ ব্যক্তি হওয়াতে প্রথম দিনের হাজার-বিশেক দর্শক হতাশ হন। অবশেষে মেলবোর্ন-এর পঞ্চম টেস্টে সর্বকনিষ্ঠ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর টেস্ট-অভিষেক হয়, তিনি তখন সাড়ে-১৭-বছরের। অভিষেক-ইনিংসে প্রবল অভিনন্দনের মধ্যে দলের ২৬৯-৩ রানে খেলতে নেমে নিল হার্ভে-র সঙ্গে তিনি ১৪৮ রানের জুটি গড়েন যার মধ্যে তাঁর নিজের ভাগ ছিল ৫৩ রান (১০৭ মিনিট), অথচ দ্বিশতাধিক রানের (২০৫) ইনিংস-খেলা হার্ভে-র থেকেও বেশি প্রশংসা পান: “Craig made only 53, but he made them like a champion. He showed no signs of a swelled head, no flashiness. Craig sold himself to his public for what he is — a level-headed fellow with dynamite in his willow and purpose in his life.” তারপর দ্বিতীয় ইনিংসে যখন তিনি দলের মোট ২০৯ রানের মধ্যে ৪৭ রান (১১৪ মিনিট) করলেন, তখন বেশির ভাগ সমর্থকেরই মনে ধারণা বদ্ধমূল হ’ল যে আরেকজন ব্র্যাডম্যানের আবির্ভাব হয়েছে! অতএব প্রত্যাশার চাপ বাড়তে থাকল।
১৯৫৩ সালের গ্রীষ্মকালে, অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ড-সফরে ক্রেগ কিন্তু মোটেই হালে পানি পাচ্ছিলেন না। আত্মবিশ্বাস ও রান, দুটোতেই ঘাটতি পড়ছিল। লর্ডস টেস্ট চলাকালীন এক ডিনার-পার্টিতে অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ‘ক্রিকেট-ক্ষ্যাপা’ রবার্ট মেঞ্জিস ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে উজ্জীবিত করতে চেষ্টা করেন, স্ট্যান ম্যাককেব-এর (১৯৩০ সালের) প্রথম ইংল্যান্ড-সফরের প্রথম দিককার ব্যর্থতার উদাহরণ দিয়ে। কিন্তু কাজের কাজ তাতে বিশেষ হয়নি। সফরের ম্যাচগুলোতে মাত্র ৪২৯ রান (গড় ১৬.৫০) ছিল তাঁর সংগ্রহ এবং কোনও টেস্টেই দলে জায়গা পাননি। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ হারে ০-১ ম্যাচে।
দেশে ফেরবার পরে, পরের বছর-তিনেক সময়ে তিনি স্কুলের পড়া শেষ করে কিছুদিনর জন্য জাতীয় সেনাবাহিনীতে (national service) আবশ্যিক সেবায় নিযুক্ত হন এবং সঙ্গে তাঁর ওষুধ-প্রস্তুতকরণ (pharmacy) শিক্ষণও শেষ করেন। ঘরোয়া শেফিল্ড শীল্ড প্রতিযোগিতায় NSW-র হয়ে ধারাবাহিকভাবে রান করায় ১৯৫৬ সালের গ্রীষ্মকালে, অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ড-সফরে যখন তিনি গেলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১-ছুঁইছুঁই, ফলে তখনও তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ বেশ ঊর্দ্ধগামীই ছিল।
এই সফরে অস্ট্রেলিয়া লেকার-লক স্পিন-জুটির হাতে বিধ্বস্ত হয়ে সিরিজ হারে ১-২ ম্যাচে। ক্রেগ মাত্র দুটো টেস্টে খেলেন ও চার ইনিংসে করেন ৫৫ রান, যার মধ্যে (লেকারের ১৯-উইকেট-নেওয়া) ম্যাঞ্চেস্টার-এ দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫৯ মিনিট লড়াই ক’রে ৩৮ রানের ইনিংসটাই একমাত্র উল্লেখযোগ্য ছিল। দেশে ফেরার পথে পাকিস্তানে একমাত্র টেস্টটা এবং ভারতে তিনটে টেস্টের দুটোতে (মাদ্রাজ ও কলকাতা) খেলেন – পাঁচটা ইনিংসে সংগ্রহ করেন মাত্র ১০০ রান। অতএব আবার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ।
১৯৫৩, ১৯৫৪-৫৫ ও ১৯৫৬ পরপর তিনটে অ্যাশেজ সিরিজে পরাজয় এবং ব্র্যাডম্যান-এর অপরাজেয় (invincibles) দলের বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের অবসরগ্রহণ এই দুই কারণে অস্ট্রেলিয়ার দলে বড়সড় পরিবর্তনের হাওয়া ওঠে। ১৯৫৬-৫৭ মরশুমে মিলার অবসর নিলে ক্রেগ-কে NSW রাজ্য-দলের অধিনায়ক করা হয় এবং NSW সেবার পরপর পঞ্চমবারের মতন শেফিল্ড শীল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়। সেখানে ক্রেগের ব্যাটিং-ফর্ম ভালই ছিল যদিও অল্পবয়সেই তাঁর শারীরিক দুর্বলতা, বিশেষত টনসিলাইটিস নিয়ে মাঝেমধ্যেই ভোগা, নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। তা সত্ত্বেও এক বেসরকারী সফরে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক নির্বাচিত হয়ে তিনি নিউজিল্যান্ডে যান, এবং ক্রাইস্টচার্চ-এর বেসরকারী ‘টেস্ট’ ম্যাচে শতরান করেন। সফরে সাতটা ম্যাচের মধ্যে দল পাঁচটা জেতে ও দুটো ড্র করে। তাঁর অধিনায়কত্ব প্রশংসিত হয়।
অতঃপর ১৯৫৭-৫৮ মরশুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে মাত্র সাড়ে-২২-বছরের ক্রেগ-কেই অধিনায়ক করা হয় [এটা আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলীয় রেকর্ড – সেই সময়ে বিশ্ব-রেকর্ডও ছিল যেটা ১৯৬২ সালে পতৌদি ভাঙ্গেন], অনেক বেশি অভিজ্ঞ হার্ভে উপেক্ষিত হন। এই সফরে অস্ট্রেলিয়া দল দারুণ সাফল্য পায় ৩-০ ম্যাচে (পাঁচ-টেস্টের) সিরিজ জেতে, সফরের ২০টা ম্যাচে অপরাজিত থাকে, এবং অ্যালান ডেভিডসন ও রিচি বেনোর মতন ক্রিকেটার অসাধারণ খেলেন। অধিনায়ক (এবং সফরের প্রথম সপ্তাহ-দুয়েক ম্যানেজারও বটে) হিসেবে ক্রেগ তাঁর দায়িত্ব চমৎকারভাবে পালন করেন, গোটা দল খুবই একাত্ম হয়ে খুশমেজাজে কাটায়।
কিন্তু ব্যাটার হিসেবে এবারও তিনি ব্যর্থ – ১৪, ১৭, ০, ৫২ (২১২ মিনিট), ০, ৩, ১৭ – সাত টেস্ট-ইনিংসে মাত্র ১০৩ রান (গড় ১৪.৭১), পাঁচবার বোল্ড ও দু’বার ক্যাচ আউট হন। সাংবাদিকতা-করা মিলার প্রশ্ন তোলেন whether the captain Craig would have to drop the batsman Craig. দেশে ফেরবার পর সাফল্যের প্রভূত আনন্দের মধ্যেও এই কাঁটাটা খচখচ করতে থাকে – what was to be done about Craig!
ভাগ্যদেবী বোধহয় এই সঙ্কটের ফয়সালা করে দিলেন – হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ক্রেগ পরের মরশুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করতে প্রায় পারলেনই না। ১৯৫৮-৫৯ মরশুমে দেশের মাঠে অ্যাশেজ সিরিজে জাতীয় দলে ফেরবার একটা চেষ্টা তিনি করেছিলেন – পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া রাজ্যদলের বিরুদ্ধে এবং সফরকারী ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে NSW-এর হয়ে দুটো ম্যাচের দুটো ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হয়ে যান – সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এদিকে সেই সিরিজে বেনোর অধিনায়কত্বে অস্ট্রেলিয়া ৪-০ ম্যাচে জেতে।
ক্রেগ আর কখনও দেশের হয়ে খেলেননি, যদিও আরো গোটা-তিনেক মরশুম তিনি ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেন, ১৯৬০-৬১ মরশুমে তাঁর অধিনায়কত্বে NSW শেফিল্ড শীল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়। ইতিমধ্যে তিনি Boots কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হয়ে গেছেন ও বিয়ে করে সংসারও পেতেছেন। অতএব খেলা থেকে অবসর নেন, তখন তাঁর বয়স ২৭-ও হয়নি।
একসময় ‘পরবর্তী ব্র্যাডম্যান’ নামে অভিহিত ক্রেগ-এর ব্যাটিং পরিসংখ্যান রীতিমত করুণ – ১১ টেস্টে মোট ৩৫৮ রান (গড় ১৯.৮৮), দুটো অর্ধশতক, প্রথম-শ্রেণীর খেলায় ১৪৪ ম্যাচে ৭,৩২৮ রান (গড় ৩৭.৯৬), ১৫টা শতরান ও ৩৮টা অর্ধশতরান। তাঁর হাল্কা-পাতলা চেহারা নিয়ে তিনি খুব জোরদার বা বড় শট খেলতেন না, তবে তাঁর ধৈর্যশীল ব্যাটিংয়ের সুমার্জিত লাবণ্য অনেককেই আকৃষ্ট করত। কিন্তু বিখ্যাত ক্রিকেট-লেখক গিডিওন হেই-এর মতে: “Comparisons with Bradman, following his 213 for New South Wales against South Africa in January 1953, were Craig’s greatest burden.” আর ক্রেগ যে নিজেকে ‘ব্র্যাডম্যান’ ব’লে কখনওই মনে করতেন না এটা ২০১৪ সালে জুলাই মাসের এক সাক্ষাৎকারে স্বয়ং তিনিই অকপটে বলেন: “Despite what the Sydney papers said, I never did see myself as being ‘another Don Bradman’. I just enjoyed playing. I didn’t have the ambition Don had.”
১৯৩৫ সালের ১২ই জুন তারিখে জন্মগ্রহণ-করা ইয়ান ডেভিড ক্রেগ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৪ সালের ১৬ই নভেম্বর চিরকালের মতন চলে গেছেন।
[কৃতজ্ঞতা-স্বীকার: শঙ্করীপ্রসাদ বসু, অভিষেক মুখার্জি, অরুণাভ সেনগুপ্ত এবং Wisden ও ESPN CricInfo]
*সমস্ত ছবি ইন্টারনেট থেকে