বলের গতি ‘বাড়তি’ না ‘কমতি’? ক্রিকেটের এক “হ-য-ব-র-ল”!

কিছুদিন যাবৎ মাঝেমধ্যেই পড়ছি বা শুনছি যে ক্রিকেটে কিছু ‘বিশেষজ্ঞ অতি-দ্রুত’ বোলাররা উঠে আসছেন, যাঁরা টি২০ ম্যাচে ইনিংস-প্রতি খুব বেশি হলে মাত্র চার ওভার [২৪টা ডেলিভারি – ওয়াইড ও নো-বল হবেনা এমন একটি প্রায়-অলীক ধারণা সত্যি হলে!] বল করতে হবে বলে, ‘প্রকৃতই দ্রুত’ বল করতে প্রবল উৎসাহিত হচ্ছেন – ধরুন ১৪০, এমনকি ১৫০ ছাড়িয়ে মাঝেসাঝে ১৬০-ও (১০০ মাইল) ছুঁয়ে ফেলতে চাইছেন। 

[সঙ্গে সঙ্গে এদিকে দেখছি হরেক কিসিমের, অবশ্যই প্রয়োজনের খাতিরে, স্লোয়ার ডেলিভারির সমাহার – ‘ব্যাক-অফ-পাম’, ‘নাকল-বল’, ‘লুজ-ফিঙ্গার-গ্রিপ’ ইত্যাদি উদ্ভাবনী কায়দা ব্যবহার করে – বহু সুবিধাভোগী ব্যাটারদের দাপট ঠেকাতে বোলারদের তূণে বাণের বিচিত্রতা ক্রমশই ঊর্ধমুখী। এ তো বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়ম।

গোড়ার কথায় ফিরি, অর্থাৎ বলের গতি নিয়ে কিছু ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ ও ক্রিকেট-প্রেমী যা দাবি করছেন। এমনও ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ হচ্ছে যে এই প্রবণতা ক্রমশ আরো বাড়বে, এই ক্রমপ্রসারণশীল বিশ্বায়িত ক্রিকেট-দুনিয়ায় যা (খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই) টি২০ (এবং হয়তো টি১০ ও হান্ড্রেডস) ক্রিকেটের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে। 

ছবি: ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ থেকে

বেশ কথা, কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যও কি তাইই বলছে?

নিছকই কৌতুহলের বশে ইন্টারনেট-এ ঢুকে কিছু অতীত তথ্য ঘাঁটলাম আর আটটা বিভিন্ন ওয়েব-সাইট থেকে আটটা বিভিন্ন রচনা থেকে (তিনধরণের ক্রিকেট মিলিয়ে-মিশিয়েই দেওয়া) কিছু তথ্য সঙ্কলিত করলাম। কি পেলাম তা সংক্ষেপে লিখি।

  • অক্টোবর-নভেম্বর-২০১৯-এ প্রকাশিত রচনাদুটো অনুযায়ী, ‘Fastest Delivery Top-10 Ranking’-এ মাত্র একজন ১৬০+ ও বাকি ন’জন ১৫০+ বিভাগে – এঁরা সবাই ‘বর্তমানের’ খেলোয়াড়।
  • ডিসেম্বর-২০২০-তে প্রকাশিত রচনাটা অনুযায়ী, এই অনুপাতটা হচ্ছে পাঁচজন ১৬০+ বিভাগে (তার মধ্যে চারজনই আবার ‘অবসরপ্রাপ্ত’ খেলোয়াড়) আর পাঁচজন ১৫৫+ বিভাগে, ১৫০+ নয়, আর তার মধ্যেও প্রায় সবাইই অবসরপ্রাপ্ত।
  • জুন-২০২১-এ প্রকাশিত রচনাদুটো অনুযায়ী তালিকায় ঐ অনুপাতটা ১:৯ (বর্তমান) ও ৫:৫ (অবসরপ্রাপ্ত)।
  • অগাস্ট-২০২১-এ প্রকাশিত রচনাটা অনুযায়ী ঐ সেই অনুপাতটা ১:৯, সবাই বর্তমানের খেলোয়াড়।
  • কিন্তু অক্টোবর-২০২১-এ প্রকাশিত রচনাদুটো অনুযায়ী তালিকাটা আরেকটু মজার – ১৬০+ বিভাগে আছেন (বর্তমানের) একজন আর বাকি ন’জন (সবাই বর্তমানের) ১৪৫+ বিভাগে, ১৫০+ নয়। 

আমি কি কিছু মিস করছি? এই তথ্যগুলো কি রচনার শুরুতে উল্লেখ-করা ‘ভবিষ্যদ্বাণী’-কে সমর্থন করছে? এই ‘বিশেষজ্ঞ অতি-দ্রুত’ বোলাররা কি ‘গোকুলে বাড়িছে সে’ জাতীয়, নাকি এটাও কোভিড-১৯ জৈব-সুরক্ষা-বলয়ের প্রভাব? একটু ভেবে দেখুন।

ও হ্যাঁ, অন্য আরো দুটো তথ্যগুচ্ছ – ১৬ বছরের ফারাকের – একটা এপ্রিল-২০০২-এর [http://static.espncricinfo.com/db/STATS/FC/BOWLING/BOWLING_SPEEDS_old.html], অন্যটা অক্টোবর-২০১৮-র [https://cricket.fandom.com/wiki/List_of_Currently_Active_Fast_Bowlers] – তারাও যেন আভাস দিচ্ছে পেসারদের বলের গতি গত দেড় দশকে একটু কমেই গেছে।

তো এই তথ্যগুলো কিভাবে শুরুতে উল্লেখ-করা ‘ভবিষ্যদ্বাণী’-র সঙ্গে মেলানো যায়?

ছবি: ইন্টারনেট থেকে

আচ্ছা এটা কি হতে পারে যে ‘ডেলিভারি স্পিড’ মাপবার পদ্ধতি গত দু’দশকে অনেক পাল্টে গেছে? কে জানে! প্রসঙ্গত জানাই যে HowSTAT! ওয়েব-সাইট কোনও বোলিং স্পিডের রেকর্ড তাঁদের সাইটে প্রকাশ করেননা। কারণ? (তাঁদের মতে):

  • বোলিং স্পিড মাপবার প্রযুক্তির কোনও নিশ্চিত মাপনির্ধারণ (guaranteed standardization) নেই। এই সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কিভাবে বসানো (installation), ক্রমাঙ্কন (calibration) ও পরীক্ষা (testing) হয়, এ ব্যাপারে তাঁদের কোনও ধারণা নেই। তাঁরা জানেন না যে বলের গতিপথের কোন অংশে তার স্পিড মাপা হয়, এবং প্রতিটি মাপের ক্ষেত্রেই তা একইরকম কিনা। সংক্ষেপে, একাধিক কারণে এই পরিমাপের অভ্রান্ততা (accuracy) প্রভাবিত হতে পারে।
  • এমন একাধিক ঘটনা আছে যেখানে মাঠের খেলোয়াড়রা নিজেরাই ঘোষিত পরিমাপের অভ্রান্ততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নাকি বলেন যে ব্রেট লি-র একটি ডেলিভারি (যা ১৫৭+ ব’লে ঘোষিত হয়), তার কয়েকটা ডেলিভারির আগের একটি ডেলিভারি (যা তুলনায় ধীরগতির ব’লে ঘোষিত হয়) থেকে তুলনায় ধীরগতির ছিল, গিলির মতে।
  • সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা বাস্তবভিত্তিক (factual) রেকর্ড নিয়ে চর্চা করেন যা সম্পূর্ণভাবে যাচাইযোগ্য (absolutely verifiable) – একজন ব্যাটার কত রান করেছেন বা একজন বোলার ক’টা উইকেট নিয়েছেন, এসব স্কোরকার্ড থেকে যাচাই করা যায়, কিন্তু ‘বোলিং স্পিড’ যাচাই করবার এমন কোনও সূ্ত্র নেই।

আপনি নিজেই পড়ুন, ভাবুন ও তারপর মতামত দিন।

[পুনশ্চ: ঐ আটটা ওয়েব-সাইটের লিঙ্ক ও প্রাপ্ত তথ্যগুলো আমার কাছে Excel ফর্ম্যাটে আছে।]