পাঠ-প্রতিক্রিয়া – “বাইশ গজের কিস্সা”

লেখক মূলত ছোটগল্পকার. এই বইটা ওঁর প্রথম ক্রিকেটীয় নন-ফিকশন, জুন-২০১৯-এ প্রকাশিত। আলগোছে বালিশে হেলান দিয়ে বসে বইয়ের ভূমিকাটায় চোখ বোলাতে বোলাতে সোজা হয়ে বসলাম। ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিমায় একটা স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, যা প্রথমে একটু আলঙ্কারিক ব’লে মনে হ’তে পারে, কিন্তু একটু পরে সেটাই পাঠককে ক্রমশ টানতে শুরু করে – টেস্ট-ক্রিকেটের সম্পদশালী ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদের মধ্যে ঘটনাগুলোর অত্যন্ত-আকর্ষক অথচ কম-পরিচিত অলিন্দে অলিন্দে সচ্ছন্দে সফর করতে করতে। আর সফরশেষে বাড়তি পাওনা হচ্ছে ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ক্রিকেটীয় চরিত্রদের সামগ্রিক টেস্ট-পরিসংখ্যান, প্রায় পঁয়তাল্লিশ পৃষ্ঠার।

লেখকের তথ্যনিষ্ঠ ও যত্নবান এই বৈশিষ্ট্যটা ইতিবাচকভাবেই ব্যতিক্রমী, বিশেষত আজকের ‘hazy half-truth’ (নাকি ‘popular post-truth’!) অধ্যুষিত ‘বাইট-বুভুক্ষু’ বাংলা ক্রীড়া-সাংবাদিকতা ও নন-ফিকশন ক্রিকেট-সাহিত্যের জগতে। বিখ্যাত ও জনপ্রিয় অগ্রগণ্য লেখকরাও কেউ কেউ অহেতুক তথ্যবিচ্যুতিতে ভোগেন, হয়ত স্মৃতির ওপর প্রয়োজনাতিরিক্ত নির্ভর করেন বা তথ্যগুলো যাচাই করতে নিছকই উপেক্ষা করেন।

এগারোটা রচনার এই সঙ্কলনে বিষয়বস্তুর নির্বাচনেও রয়েছে ‘জারা হঠকে’ থাকা বিশেষত্বের ছোঁয়া – আছে তুলনামলকভাবে অনামী-অখ্যাত ক্রিকেটারদের পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। একঝলক তাকানো যাক এই চরিত্রগুলোর তালিকার দিকে – ইব্রাহিম মাকা, রয় পার্ক, নারায়ণ স্বামী, ডগলাস ফ্রিম্যান, সুব্রত ব্যানার্জি, রবিন জ্যাকম্যান, আইভো ব্লাই, এলিস আচং, ইত্যাদি। এঁদের নাম কতজন ক্রিকেটপ্রেমী কতবার শুনেছেন? এঁরা কেউ টেস্টে একদিনে ৩০০ রান করেননি, বা টেস্ট-জীবনকালে ১০,০০০ রান করেননি বা ৮০০টা উইকেট নেননি বা ২০০টা ম্যাচ খেলেননি – কিন্তু খেলাটার প্রতি টান তো এঁদেরও ছিল, তাই না!

এই বইতে রয়েছে পঞ্চাশের দশকের ভারতীয় উইকেট-রক্ষকদের ‘musical chair’-এর ঘটনা, মার্চ-২০১৫-র কোটলায় আমলা-ডি’ভিলিয়ার্সের ‘blockathon’, জর্জটাউন-করাচি-কলম্বো-ফয়জালাবাদ-মেলবোর্ন প্রভৃতি জায়গায় ‘cancelled’ বা ‘abandoned’ টেস্টগুলোর কাহিনী, ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা আউড়ে টাইসনের ‘sledging’, দলকে জেতাতে ‘substitute’ ফিল্ডারদের অবদান, বিভিন্ন দেশের মধ্যে হওয়া টেস্ট-সিরিজের ‘trophy’-র বৃত্তান্ত, মাঠে চায়নাম্যান-গুগলি-দুসরা ডেলিভারির আবির্ভাবের বর্ণনা – এমন সব রকমারি অ-প্রচলিত কিন্তু সুস্বাদু খাবারের এক আকর্ষক buffet! রাতদিন কেবল শচীন-সৌরভ-রাহুল-মাহি-বিরাট-রোহিত-ঋদ্ধি-ঋষভ ‘সংকীর্তন’ অথবা বিশ-বিশের ‘দিলাম-নিলাম’ এইসবের থেকে মুখ বদলাতে মাঝেমধ্যে খানিক আস্বাদন করলে ভালই লাগবে বলে মনে হয়।

ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে পরিবর্ত খেলোয়াড়, প্রধানত ফিল্ডারদের, নিয়ে লেখা রচনাটা, “ভাড়াটিয়ার গেরস্থালি”। যাঁরা শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখা “নট আউট” বইটা পড়েছেন, তাঁদের হয়ত মনে পড়ে যাবে “ক্রিকেটে উপেক্ষিত” অধ্যায়টা, মনে পড়বে ‘মিত্তিরদা’-কে, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম-শ্রেণীর ঘরোয়া ক্রিকেটার নিউ সাউথ ওয়েলস-এর ১৯৬১-৬২ মরশুমের ‘স্থায়ী দ্বাদশ ব্যক্তি’ রে ফ্লকটন-কে। ২০০৫-এর অ্যাশেজ সিরিজে নটিংহ্যামের রুদ্ধশ্বাস চতুর্থ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের পরিবর্ত ফিল্ডার গ্যারি প্র্যাট-কে হয়ত অনেকেই মনে করতে পারবেন [কেন বলুন তো!], কিন্তু গোপালস্বামী কস্তুরীরঙ্গন (কলকাতা, ১৯৬১-৬২), প্রকাশচন্দ্র পোদ্দার (দিল্লি, ১৯৬৩-৬৪), দেবরাজ গোবিন্দরাজ (কিংস্টন, ১৯৭১), ইয়ান গৌল্ড (মেলবোর্ন, ১৯৮২-৮৩), গুরশরণ সিং (আহমেদাবাদ, ১৯৮৩-৮৪), রড টাকার (হোবার্ট, ১৯৮৯-৯০), পিটার ক্যান্ট্রেল (ব্রিসবেন, ১৯৯০-৯১), স্কট এলস্টোন (নটিংহ্যাম, ২০১১) – এঁদের নাম কতজন মনে করতে পারেন? এঁরা তো ঐ টেস্ট স্কোরকার্ডগুলোতে রয়ে গেছেন সেই টেস্টগুলোতে না খেলেও।

সবশেষে বলি বইয়ের কাগজ-ছাপাই-বাঁধাই-অলঙ্করণ ইত্যাদি ভাল। প্রায় দেড়শো পৃষ্ঠার বইটাতে মুদ্রণ-প্রমাদ ও বানান-ভুল সংখ্যায় অতি নগণ্য। অর্থাৎ সম্পাদনা ও প্রুফ-রিডিংয়ের কাজে যত্নের ছাপ আছে। পরিষ্কারভাবে ছাপা ছবিগুলোর ’16-member squad’-টা বিশেষভাবে চমৎকার, কারণ সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রচনাগুলোর উল্লেখ করা আছে, পাঠকদের জ্ঞাতার্থে – বলতে দ্বিধা নেই যে এটাও একটা শিক্ষণীয় ব্যাপার।