৫৬-র বোলিং লাইন টপকে আজ ৫৭-তে পা ফেলছেন। স্যুইং বোলিংয়ের সর্বকালের অবিসংবাদী “সুলতান” ওয়াসিম আক্রামের খেলোয়াড় জীবনের শেষ ৬ বছর তাঁর নিকটতম সঙ্গী ছিল ডায়াবেটিস। তবু ব্যাটে আর একটু মন দিলে টেস্টে সর্বোচ্চ ২৫৭ করা তিনি নিঃসন্দেহে ক্রিকেট-বিশ্বের সর্বকালের এক সেরা অল-রাউন্ডারের দাবীদার হয়ে যেতে পারতেন।
ডিরেক্ট বা রিভার্স, স্যুইং বোলিংয়ের সর্বকালের অবিসংবাদী সুলতান তিনি। যে কোন পরিবেশে, যে কোন পিচে, যে কোন ম্যাচ-কন্ডিশনে, যে কোন রঙের বল হাতে তিনিই অন্যতম সেরা স্যুইং বোলিং পারফর্মার। বার বার এটা তিনি প্রমাণও করেছেন। আর তা মুক্তকণ্ঠে বারবার স্বীকার করে গেছেন ক্রিকেট-দুনিয়া আলো-করে-রাখা ব্যাটাররা, যাঁদের মধ্যে আপনি পেয়ে যাচ্ছেন গত শতাব্দীর ৮০-র দশকের সুনীল গাভাসকার, দিলীপ বেঙ্গসরকার, ভিভিয়ান রিচার্ডস, অ্যালান বর্ডার থেকে ৯০-এর দশকের শচীন তেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, ব্রায়ান লারা, অরবিন্দ ডি’সিলভা হয়ে এ শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রথমাংশের ক্রিস কেয়ার্নস, রিকি পন্টিং, জাক ক্যালিস, ম্যাথু হেডেনরা। এমনকি তাঁর প্রজন্মের অন্যতম সেরা ফাস্ট-বোলার কার্টলি অ্যামব্রোজও বারবার তাঁকে ভরিয়ে দিয়েছেন দরাজ প্রশংসায়।
তাঁর কেরিয়ারের অধিকাংশ সময় স্যুইং ও ফাস্ট বোলিংয়ের আদর্শ পরিবেশ তাঁর জন্য সাজানো ছিলনা, যেটা অনেকটাই পেয়েছিলেন – তাঁর অগ্রজ বিশ্ব-কাঁপানো ফাস্ট-বোলার ডেনিস লিলি, জেফ টমসন, মাইকেল হোল্ডিং বা ম্যালকম মার্শালরা অথবা তাঁর প্রজন্মের কোর্টনি ওয়ালশ, অ্যালান ডোনাল্ড, কার্টলি অ্যামব্রোজ বা গ্লেন ম্যাকগ্রারা। বরং তাঁকে বেড়ে উঠতে হয়েছে পাকিস্তানের আর উপ-মহাদেশের “ধূলিধূসর, স্পিনারদের জন্য টেলর-মেড স্লো আর মরা” পিচে বোলিং করে। আর সেই বোলিং করতে হয়েছে ইমরান খান আর সরফরাজ নওয়াজ ছাড়া সামনে তেমন কোন পেস বোলিং “আইডল-কে না দেখতে পেয়েই। পেসারদের জন্য কোন “ইনসেনটিভ” সেসব পিচে ছিল না কোনদিনই। তবে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮, ইংলিশ কাউন্টিতে ল্যাঙ্কাশায়ার দলের হয়ে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি, বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ ও সানডে লিগ প্রতিযোগিতায় বোলিং ওপেন করে গেছেন। ১৯৯৮ সালে ওঁর নেতৃত্বে ল্যাঙ্কাশায়ার জেতে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি ও সানডে লিগ এবং কাউন্টি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। স্থানীয় ব্রিটিশ সমর্থকদের তিনি প্রিয় ছিলেন।
ইনস্যুইং, ঘাতক ইনস্যুইং ইয়র্কার আর রিভার্স স্যুইং, এতসব বৈচিত্র্যময় অস্ত্র ছিল তাঁর তূণে, যার থেকে বাঁচাটা চূড়ান্ত চক্কর ছিল সে সময়ের সেরা ব্যাটারদের জন্য। কোর্টনি ওয়ালশ, অ্যালান ডোনাল্ড, কার্টলি অ্যামব্রোজ বা গ্লেন ম্যাকগ্রারা একটা সময় সেরা ব্যাটসম্যানদের সিলেবাসে ঢুকে যেতেন কিন্তু অসীম বৈচিত্র্যময় তিনি সেরা ব্যাটসম্যানদের কাছেও “আনসিন” প্রশ্নপত্র হয়ে থেকে গেছেন দীর্ঘদিন। সাধে কি আর কার্টলি অ্যামব্রোজ বলেছিলেন যে “ওয়াসিম ইজ দ্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোর অফ পেস বোলিং”?
নেভিল কার্ডাস বর্ণিত “গাধা স্কোরবোর্ড”-ও কখনও কখনও “সত্যি কথা” বলে ফেলে। আর সেই স্কোরবোর্ড একেবারেই “নির্মোহ মোডে” জানাচ্ছে যে আবির্ভাব সিরিজে জীবনের ২য় টেস্টে ১৯৮৫-র ফেব্রুয়ারিতে তিনি ১২৮ রানে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে, ডুনেডিনে। ১৭ বছর ১ মাসে (জানুয়ারি ১৯৮৫ – জানুয়ারি ২০০২) ১০৪টি টেস্ট খেলে ১৪৭ ইনিংসে ২২.৬৪ গড়ে ১টি দ্বিশতরান সহ ৩টি শতরান আর ৭টি অর্ধশতরান ছিল তাঁর ২,৮৯৮ রানে (অক্টোবর ১৯৯৬-তে ১২x৬ আর ২২x৪ সহ সর্বোচ্চ ২৫৭*, বনাম জিম্বাবোয়ে), উইকেট নিয়েছেন ৪১৪টি (ইনিংস সেরা বোলিং ৭/১১৯ ও ম্যাচ সেরা বোলিং ১১/১১০) আর ৪৪টি ক্যাচও ছিল তাঁর সংগ্রহে। টেস্টে ৮ নম্বর ব্যাটার হিসেবে ব্যাট হাতে মাঠে নেমে ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান (২৫৭*) করবার ও সবচেয়ে বেশি ছক্কা (১২) মারবার রেকর্ড আজও তাঁরই দখলে, দুটোই জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে সেই শেখুপুরা ম্যাচে।
আর ১৮ বছর ৫ মাসে (নভেম্বর ১৯৮৪ – মার্চ ২০০৩) ৩৫৬টি ওডিআইতে ২৮০ ইনিংসে ১৬.৫২ গড়ে (স্ট্রাইক রেট ৮৮.৩৩) ৬টি অর্ধশতরান ছিল তাঁর ৩,৭১৭ রানে (সর্বোচ্চ ৮৬), উইকেট নিয়েছেন ৫০২টি (সেরা বোলিং ৫/১৫) এবং ৮৮টি ক্যাচও নিয়েছিলেন তিনি।
খেলা ছাড়ার পরে তিনি ধারাভাষ্যকার হন এবং যথেষ্ট ভালোভাবে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিতর্কও তাঁর অলঙ্কার হয়ে ঘিরে ছিল তাকে, কিন্তু সবসময়ই তা থেকে সদর্পে বেরিয়ে গেছেন তিনি। তা সে ইংল্যান্ডে ১৯৯২-তে বল ট্যাম্পারিং, ১৯৯৩-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজে মারিহুয়ানা রাখা (অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি) বা ১৯৯৬-এর বিশ্বকাপে অধিনায়ক হয়েও ভারতের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, কোনটাই শেষ অবধি ডায়াবেটিসের মত লম্বা ছায়া ফেলেনি তাঁর কেরিয়ারের পারফরম্যান্সে, যেমন স্বাস্থ্যের কারণে ২০০৩ মরসুমে হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির সঙ্গে একবছরের চুক্তি থেকে মাঝপথে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া।
নিজের কলেজ দলেও স্থান না পাওয়া বাঁ-হাতি এক কিশোর পেস বোলার তাঁর জন্ম-শহরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে ট্রায়ালে এসে প্রথম দু’দিন বল করার সুযোগ না পেয়েও তৃতীয় দিন প্রথম সুযোগেই তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়কের নজরে পড়েছিলেন। জাভেদ মিয়াঁদাদের সুপারিশেই তাঁর জাতীয় দলে ঢোকার দরজা খুলেছিল ১৯৮৪-৮৫-র নিউজিল্যান্ড সফরে। তারপরের গল্পগাথা ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতির মহাফেজখানায় ৯১৬টি আন্তর্জাতিক উইকেট ও ৬,৬১৫টি আন্তর্জাতিক রানের কোলাজসমেত সযত্নে সাজানো আছে। রোজ মনে মনে সে কোলাজ দেখে নেন হাজার হাজার ক্রিকেট-রসিক আর খুঁজে নেন দেশ ও সময়ের সীমানা ছাড়ানো প্রশান্তিমাখা রোমন্থন মুহূর্ত।
বাকিটা জানে ইতিহাস। আজও বাকি ক্রিকেট দুনিয়ায় এবং ভারতেও সসম্ভ্রমে উচ্চারিত হয় পাকিস্তানের এক স্যুইংপ্রবাদের আলোকপ্রভ ও অভ্রংলিহ বোলিং দক্ষতার স্ফুরণকথা। আশা করি, তা হতে থাকবে আরো বহুদিন।
সেই “ডিপার্টমেন্টাল স্টোর অফ পেস বোলিং” আজ মৃদু পায়ের ছোট রান-আপে ৫৬র পপিং ক্রিজে পৌঁছে তা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন ৫৭-র দিকে।
শুভ জন্মদিন, “স্যুইংয়ের সুলতান”।